শিক্ষাব্যবস্থার সকল বৈষম্য নিরসন হোক

দুলাল মিয়া, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস । শিক্ষকদের জন্য দিবসটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্মরণ করার জন্য এ দিনটিকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শিক্ষকদের সম্মানার্থে পালিত এটি একটি বিশেষ দিবস। ২০২৪ এ বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘শিক্ষকের কণ্ঠস্বর : শিক্ষায় নতুন সামাজিক অঙ্গীকার।’ দিবসটি উপলক্ষে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যালি, আলোচনা সভা ও সেমিনার  আয়োজন করতে বলা হয়েছে। 

শিক্ষা ক্ষেত্রে যেকোনো পরিবর্তন অবশ্যই শিক্ষকদের দিয়ে শুরু করতে হয়; অর্থাৎ শিক্ষকের পরিবর্তন হলে শিক্ষার্থীর পরিবর্তন হয়। আর তখনই শিক্ষার পরিবর্তন ঘটে।  শিক্ষা ব্যবস্থায় যেকোনো পরিবর্তন শিক্ষকদের দ্বারাই বাস্তবায়ন করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানমনষ্ক ও মানবিক সমাজ গঠন করার জন্য মানসিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদিতে পরিবর্তন আনা সর্বাগ্রে জরুরি। মানসিকতা ও চিন্তার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে একটি সুন্দর সমাজ তৈরি করা খুবই  কঠিন হবে। চিন্তা আর মনন গঠনের জন্য প্রথমেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়নে মূল কাজটিই করেন শিক্ষক।

শিক্ষকরাও মানুষ। একজন মানুষ হিসেবে মৌলিক চাহিদা পূরণে তাকে এগিয়ে আসতে হয়। জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা পূরণের ঘাটতি আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ প্রতীয়মান হলে সেখানে নীতিকথা আর টিকে না। এ জন্য একজন মানুষ হিসেবে পেশার বিনিময়ে তিনি ন্যূনতম সামাজিক ও আর্থিক নিশ্চয়তা কামনা করেন।

শিক্ষকতা পেশাকে সম্মানজনক অবস্থানে নিতে হলে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি, দায়িত্ব ও অধিকার, প্রশিক্ষণ, চাকরির নিরাপত্তা, শৃঙ্খলা বিধানের প্রক্রিয়া, পেশাগত স্বাধীনতা, কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন, শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, কার্যকর শিক্ষাদান ও শিখনের পরিবেশ, আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ওপর কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।

সীমাহীন বৈষম্যে ক্ষুব্ধ আজ দেশের বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। একসময় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিয়োগ, যোগ্যতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। কিন্তু আজ তো তা নেই। এখন পিএসসির আদলে এনটিআরসিএর মাধ্যমে অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে মেধাবী ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ পাচ্ছেন। কিন্তু অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক- কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে পাহাড়সম বৈষম্য বিরাজমান। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা মাত্র ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া পান। অথচ একজন সরকারি স্কুল ও কলেজের একই পদমর্যাদার শিক্ষক-কর্মচারী তার জাতীয় বেতন স্কেলের ৪৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া পান। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা মেডিক্যাল ভাতা পান মাত্র ৫০০ টাকা আর সরকারি শিক্ষক - কর্মচারীরা পান ১ হাজার ৫০০ টাকা। বেসরকারি শিক্ষকরা ঈদ বা পূজায়  তাদের বেতন স্কেলের ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পান। কর্মচারীরা পান ৫০শতাংশ উৎসব ভাতা।  কিন্তু সরকারি শিক্ষক- কর্মচারীরা তাদের বেতন স্কেলের সমপরিমাণ দুটি পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা পেয়ে থাকেন। সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা শিক্ষাভাতা, স্বাস্থ্য ও দুর্ঘটনা বিমা, যাতায়াত ভাতা, টিফিন ভাতা, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা, হাওর ও পাহাড়ি অঞ্চলের সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা হাওর, পাহাড়ি ও দুর্গম ভাতা, উপকূলীয় ভাতা, প্রমোশন, বদলি ও চাকরি থেকে অবসরের পর পেনশনসহ রাষ্ট্র প্রদত্ত সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক- কর্মচারীরা সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের ন্যায় রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সকল দায়িত্ব সমভাবে পালন করার পরও  রাষ্ট্র প্রদত্ত যৌক্তিক ও ন্যায্য প্রাপ্য সমস্ত  সুযোগ-সুবিধা থেকে আজও বঞ্চিতই রয়ে গেছেন।

এমপিওভুক্ত কলেজে অনুপাত প্রথা বাতিল করে শিক্ষকদের যোগ্যতা ও মেধানুসারে পদোন্নতি দেয়া এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে  অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের জন্য বিধি মোতাবেক নিয়োগ প্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্রুত এমপিও প্রদানসহ কলেজ শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৫ বছর করার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট শিক্ষকরা দীর্ঘ দিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছেন।

 বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা গত ১ আগস্ট  চূড়ান্ত হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক কিছু শর্ত সাপেক্ষে পারস্পরিক বদলির আবেদন নিষ্পত্তি করতে পারবেন। বদলির সাধারণ শর্ত সমূহ হলো: শুধু সমপদে কর্মরত দুজন শিক্ষকের লিখিত সম্মতিপত্রসহ পারস্পারিক বদলির আবেদন বিবেচনা করা হবে; চাকরির আবেদনে উল্লিখিত নিজ জেলা ব্যতীত অন্য জেলায় বদলির জন্য আবেদন করা যাবে না। তবে নারী আবেদনকারীরা স্বামীর জেলায় বদলির জন্য আবেদন করতে পারবেন; নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকের চাকরি দুই বছর পূর্ণ হলে বদলির আবেদন করা যাবে; অসম্পূর্ণ বা ভুল তথ্যসংবলিত আবেদন বিবেচনাযোগ্য হবে না এবং চাকরিজীবনে কেবল একবারই বদলি হওয়ার সুযোগ থাকবে। এ ছাড়া অন্য শর্তের মধ্যে রয়েছে বদলির আবেদন অধিকার হিসেবে দাবি করা যাবে না; বদলিকৃত শিক্ষকরা কোনো ধরনের টিএ/ডিএ ভাতা পাবেন না। আদেশ জারির ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বদলি শিক্ষকের অবমুক্তি নিশ্চিত করবেন। এমপিওভুক্ত শিক্ষক সমাজ মনে করেন এটি বদলির নামে তামাশা। যা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার করেছে।এধরণের বৈষম্যমূলক বদলি প্রক্রিয়া শিক্ষকরা চান না। তারা চান সরকারি চাকরিজীবীদের ন্যায় শর্তহীনভাবে বদলি। বৈষম্যহীন বদলির দাবিতে শিক্ষকদের আন্দোলন চলমান রয়েছে।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে  এমপিওভুক্ত  ৯৭ ভাগ এবং সরকারি মাত্র ৩ ভাগ।  দেশের তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু ওইসব এমপিওভুক্ত  এবং সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চরম বৈষম্য বিদ্যমান। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে অনেক উন্নন হয়েছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হচ্ছে না। এর অন্যতম কারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সীমাহীন বৈষম্য বিরাজমান। যেকোনো দেশ বা জাতির উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত ও সমৃদ্ধ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের অনেক উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে না। বরং সময় যত যাচ্ছে শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে। উন্নয়ন ও বৈষম্য একসঙ্গে চলতে পারে না। তাই শিক্ষা ব্যবস্থা ও শিক্ষার মানোন্নয়ের লক্ষ্যে সমস্ত অসঙ্গতি ও বৈষম্য দূরীকরণের জন্য অত্যন্ত জরুরি ভিত্তিতে  প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। এর ব্যত্যয় হলে কাঙ্ক্ষিত  লক্ষ্যে পৌঁছানো আমাদের জন্য অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়বে।

শিক্ষক ছাড়া কোনো সমাজ নেই। প্রত্যেক মানুষেরই শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষকতা একটি মহান ব্রত। একটি উৎকৃষ্ট সমাজ বিনির্মাণে উৎকৃষ্ট শিক্ষকের বিকল্প নেই। আর একজন উৎকৃষ্ট মানুষই হতে পারেন, একজন উৎকৃষ্ট শিক্ষক। উৎকৃষ্ট শিক্ষকের মর্যাদাও সবার উর্ধ্বে। যে সমাজে উৎকৃষ্ট শিক্ষকের সংখ্যা যত বেশি সে সমাজ ততোই উন্নত ও সম্বৃদ্ধ ।দেশে সুনাগরিক সৃষ্টির লক্ষ্যে শিক্ষকের সর্বাধিক সম্মান ও সম্মানী নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। 

শিক্ষকের দায়িত্বও অনেক। সুশিক্ষক হিসেবে উত্তম চিন্তা ও কর্ম করলে সমাজে উত্তম মানুষ তৈরি হবে। বৈশ্বিক করোনা মহামারী, মানবিক বিপর্যয় ও অর্থনৈতিক সংকটে আক্রান্ত হয়েও শিক্ষকসমাজ মানবিক, সৃজনশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিজ্ঞানমনস্ক  সমাজ বিনির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করছেন। শিক্ষাব্যবস্থার বৈষম্য দূরীভূত হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে। শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। বিশ্ব শিক্ষক দিবস অমর হোক।

লেখক: প্রভাষক, ছাতক,সুনামগঞ্জ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বিপিসি ও বাকশিস‘র - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবি বিপিসি ও বাকশিস‘র শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি আসছে! - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ ঘোষণার প্রতিশ্রুতি আসছে! ‘আমরা রক্ত দিচ্ছি আর ওরা সচিবালয়ে বসে টাকা ভাগ করছে’ - dainik shiksha ‘আমরা রক্ত দিচ্ছি আর ওরা সচিবালয়ে বসে টাকা ভাগ করছে’ অবশেষে ইএফটিতে এমপিও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া শুরু - dainik shiksha অবশেষে ইএফটিতে এমপিও শিক্ষকদের বেতন দেওয়া শুরু দুই শতাধিক জাল শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ - dainik shiksha দুই শতাধিক জাল শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023880004882812