শিক্ষাভবনে অনিয়ম : রাজধানীর স্কুলে ঘুরেফিরে তারাই প্রধান শিক্ষক পদে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজধানী ঢাকার সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তত দেড় ডজন প্রধান শিক্ষক বছরের পর বছর একই জায়গায় চাকরি করছেন। সবচেয়ে বেশি মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ হাফিজুল ইসলাম- ১৪ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। অথচ সরকারি চাকরিবিধি অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পরপর তাদের কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ার কথা। কিন্তু ‘অদৃশ্য শক্তির’ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসনের প্রধান শিক্ষক পদে ঘুরেফিরে তাদেরই পদায়ন হচ্ছে। আর ক্ষমতাবান এসব প্রধান শিক্ষকের কারণে অন্যরা রাজধানীতে পদায়ন হতে পারেন না। দীর্ঘদিন ঢাকায় চাকরির সুবাদে এদের কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সিন্ডিকেট, মালিক ফ্ল্যাট বাড়ির। কারো কারো বিরুদ্ধে রয়েছে অদক্ষতা ও অযোগ্যতার অভিযোগ। প্রসঙ্গত, ঢাকা মহানগরে ৩৮টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। বুধবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায় সবশেষ গত ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা তেজগাঁও কলেজ থেকে ছাত্রলীগ নামধারী কয়েকজন গুণ্ডা এনে সহকর্মী শিক্ষক মেসবাহ উদ্দিনকে অপদস্থ করিয়েছেন। স্থানীয় সাংসদ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মো. আসাদুজ্জামান খান কামালের হস্তক্ষেপে ঘটনার সমাপ্তি হয়েছে। এরপর গত সোমবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) রেবেকা সুলতানাসহ তিন প্রধান শিক্ষককে রাজধানীর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অদল-বদল করে আদেশ জারি করে।

আরও পড়ুন :  শিক্ষাভবনে অনিয়ম : শিক্ষকদের টাইম স্কেল পাইয়ে দিতে কোটি টাকার চাঁদাবাজি

তবে বদলি কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয় উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রধান শিক্ষক হয়েও নারীদের স্কুলে গুণ্ডা নিয়ে সহকর্মীকে অপদস্থ করেছেন- তা মামুলি বদলির মাধ্যমে শেষ হতে পারে না। তবু তাকে তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বদলি করে দেড় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করা হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাউশির একজন কর্মকর্তা বলেন, বদলি কোনো শাস্তিযোগ্য অপরাধ না হলেও রাজধানীর বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত প্রধান শিক্ষকরা অত্যন্ত ক্ষমতাবান। বছরের পর বছর ধরে

তারা একই কর্মস্থলে কাজ করছেন। এর ফলে সহকর্মী সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে আচরণও ক্ষেত্রবিশেষে মারমুখী হয়ে ওঠে। রাজধানীর সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় গতি আনতে হলে খুব দ্রুত অন্তত ২০ জন প্রধান শিক্ষককে ঢাকার বাইরে বদলি করে পাঠাতে হবে। তবে এই বদলির কাজটি সহজ নয় এবং তা কেউ করবেও না। কারণ সবাই কোনো না কোনোভাবে সুবিধাভোগী।

আরও পড়ুন : শিক্ষাভবনে এবার ‘বিষয়’ পরিবর্তনে কেলেঙ্কারি

জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের (মাউশি) সচিব মো. মাহবুব হোসেন  বলেন, তাদের বদলির কাজটি মাউশি মহাপরিচালকের দপ্তর থেকে বাস্তবায়নের কথা। কাজেই এ প্রশ্নের উত্তর মাউশি মহাপরিচালকই দিতে পারবেন। তবে মাউশি মহাপরিচালকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, তিনি আমাকে বলেছেন রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের বদলির কাজ শুরু করবেন।
মাউশি মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, বেশিদিন ধরে একই কর্মস্থলে কর্মরত এমন প্রধান শিক্ষকদের সরানোর কাজ শুরু হয়েছে। সোমবার রাজধানীর তিনজন প্রধান শিক্ষকের কর্মস্থল পরিবর্তন হয়েছে। পর্যায়ক্রমে বাকিদেরও সরানো শুরু হবে। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোমবার মাউশি থেকে যে তিন প্রধান শিক্ষকের কর্মস্থল পরিবর্তন হয়েছে তার মধ্যে একজন হচ্ছেন গৌর চন্দ্র মন্ডল। তাকে তেজগাঁওয়ের শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক করা হয়েছে। শহীদ মনু মিঞা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগে তিনি মাউশির বিদ্যালয় শাখায় সহকারী পরিচালক এবং পরে মাউশির ঢাকা অঞ্চলের উপপরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন। গত ২০ বছর ধরে তিনি মাউশির কর্মকর্তা এবং ঢাকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে কাজ করছেন। মোহাম্মদপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহারকে সরিয়ে আনা হয়েছে তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। মোহাম্মদপুরে প্রায় ৬ বছর প্রধান শিক্ষক পদে কাজ করার পর তাকে তেজগাঁওয়ে সরানো হলো। সেই হিসেবে ঢাকায়ই তারা থাকছেন এবং খবরদারিও করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, শুধু এই তিন প্রধান শিক্ষকই নয়, রাজধানীতে একই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বছরের পর বছর ধরে ঘুরেফিরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করা অন্তত আরো ১৫ জনের হদিস মিলেছে। এর মধ্যে খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মেহেরুন্নেছা ৮ বছর, টিকাটুলি কামরুননেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে ওবায়দা বানু প্রায় ১০ বছর, তেজগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শাহরীন খান রূপা ৭ বছর, ধানমন্ডি কামরুননেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাছরিন আক্তার ৯ বছর, নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেবেকা সুলতানা ১০ বছর, ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাবিনা ইয়াসমিন ৫ বছর, মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন নাহার শাহীন ৫ বছর, মিরপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাসরিন সুলতানা ১০ বছর, রূপনগর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামরুন নাহার চৌধুরী ৫ বছর, শেরেবাংলানগর সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শফিকুর রহমান ৮ বছর, শেরেবাংলা নগর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা সৈয়দা জিন্নাতুন নূর ৭ বছর, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ সংযুক্ত হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক রহিমা আক্তার ৫ বছর এবং হাজী এম এ গফুর সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইতি রাণী মূখার্জি প্রায় ৫ বছর ধরে কর্মরত। অথচ তাদের ৩ বছর চাকরি শেষে কর্মস্থল পরিবর্তন করার কথা। কিন্তু মাউশি তা করেনি।

রাজধানীর অন্যতম নামি সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে আবু সাঈদ ভূঁইয়া ২০১১ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। ২০১৪ সালে তিনি বদলি হয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক হন। সেখান থেকে ২০১৭ সালে ফিরে আসেন ল্যাবরেটরি স্কুলে। দ্বিতীয় দফায় চার বছর ধরে দায়িত্ব পালন করা গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবু সাঈদ ভূঁইয়া টানা এক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার কি কি সুফল রয়েছে তা জানিয়ে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসন ঠিকভাবে পরিচালনা করা যায়। পড়াশোনার মানও বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে পাসের হার। তবে টিকাটুলি কামরুননেছা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওবায়দা বানু পাল্টা প্রশ্ন করে বলেন, আমি কয় বছর ধরে এই স্কুলে আছি, আর তাতে কি হয়েছে বা কি হবে- এসব আপনাকে বলতে যাব কেন? মতিঝিল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন নাহার শাহীন বলেন, একজন প্রধান শিক্ষক বেশি দিন কর্মস্থলে থাকার সুযোগ পেলে প্রতিষ্ঠানটিকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারেন। এতে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বাড়ে। তবে বেশি দিন কর্মস্থলে থাকলে এর মন্দ দিকটি কি- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এটি ভাবিনি।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, একই স্থানে দীর্ঘদিন ধরে শিকড় গেঁড়ে বসা কর্মকর্তারা নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রচুর আয়ের উৎস থাকায় সেখান থেকে তারা কোনোভাবেই বদলি হতে চান না।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0040180683135986