শিক্ষার মনোকষ্ট জাতির অগ্রগতির অন্তরায়। মানব জীবনের কষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সাময়িক পীড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে। শিক্ষার মনোকষ্টের ক্ষতি ব্যাপক। এ মনোকষ্ট ব্যক্তি তথা দেশকে পেছনের দিকে ঠেলে দেয়। এ থেকে বাংলার রাখাল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঊষালগ্নে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছিলেন। এতে বাংলার গরিব আপামর জনসাধারণের সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত হয়েছিলো। সেদিনের ধ্বংসস্তুপের মধ্যে অবস্থানরত বাংলাদেশ জন্য এ এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ। কত বিশাল হৃদয়ের অধিকারী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, এ মহাপ্রাণ সেদিন ক্ষমতায় না আসলে জাতীয়করণের স্বপ্ন কেউ কল্পনাও করতোনা। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরাসূরি তারই তনয়া জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থেকে আরো ২টি দুঃসাহসী উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। একটি হলো ২৬ হাজার ১৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ। অপরটি হলো প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে উৎসবমূখর পরিবেশে নতুন বই বিতরণ। শিক্ষায় অসংখ্য উদ্যোগ গ্রহণ করে দেশ-বিদেশে বর্তমান সরকার শিক্ষাবান্ধব হিসাবে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। বঙ্গবন্ধুর মতো তার কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বিশাল হৃদয়ের অধিকারী। বাঙালি জাতির জন্য তার ভালোবাসা কানায় কানায় পূর্ণ। বিশাল বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন, বাঙালি সংগ্রামী জাতি।
তারা পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যনেলসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম। উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। তারপরও শিক্ষার কতিপয় মনোকষ্ট স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে দূর করা জরুরি। কিছুদিন আগে বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এতে সরকারি -বেসরকারি হাইস্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের বৈষম্য দূর হবে বলে শিক্ষকরা আশাবাদী। পাশাপাশি জাতীয়করণের প্রত্যাশা অনেকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি এদেশের শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আন্তরিক। এদেশের শিশুদের মধ্যে তিনি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও শিশু রাসেলকে দেখতে পান। শিশু শিক্ষার সবচেয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। গরু, ছাগল, মৎস্য, শিক্ষা, কৃষিসহ সব মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার সার্ভিস বিদ্যমান।
একমাত্র দীর্ঘ ২ যুগ নিজস্ব ক্যাডারবিহীন চলছে সর্ববৃহৎ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দক্ষ অভিজ্ঞ ক্যাডার কর্মকর্তা দিয়ে চলে আসছে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়টি। তাদের প্রাথমিক শিক্ষার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মোটেই নেই। এর ফলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঝে মাঝে হোঁচট খেয়ে চলছে প্রাথমিক শিক্ষা। এ মনোকষ্ট দূর করার প্রয়াসে সহকারী শিক্ষক পদকে এন্ট্রি ধরে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত শতভাগ পদোন্নতি আশু বাস্তবায়ন জরুরি।
তৃণমূল থেকে অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ জ্ঞান নিয়ে স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করা করা হলে, রাষ্ট্রের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় ব্যতিরেকে গড়ে উঠবে স্মার্ট বাংলাদেশ, গড়ে উঠবে শিশু বান্ধব প্রাথমিক শিক্ষা।
বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্ব শিক্ষার্থী সংকটে আজ বিলীন হতে চলছে। শিক্ষার দু’টি মন্ত্রণালয় যেখানে জাতীয় সংসদে গৃহীত শিক্ষানীতির পৃষ্ঠপোষকতা করবে, সেখানে মন্ত্রণালয় দুটির বিপরীতমুখী বন্ধুত্বমূলক অবস্থান। জাতীয় শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্ঠভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষা স্তর ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত। এতে গরিব মানুষের সন্তানদের কমপক্ষে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত হবে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সাপেক্ষে প্রতি উপজেলায় একাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করে কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় হাইস্কুল এমনকি উচ্চ বিদ্যালয় সাথে সংযুক্ত কলেজগুলোতে নার্সারি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শাখা খোলার হিড়িক পড়ে যায়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে চলে ভর্তিসহ সব কার্যক্রম। শিশু শিক্ষার বাণিজ্য এখন তুঙ্গে। জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকটের আরেকটি কারণ যত্রতত্র কিন্ডারগার্টেন ও এবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপন। জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অস্তিত্ব সংকটের হাত থেকে রক্ষার করার অভিপ্রায়ে যত্রতত্র বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপনের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ প্রয়োজন। শিশু মনোবিজ্ঞানসম্মত পাঠদানে বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অন্যতম মনোকষ্ট তাদের দুপুরে গরম ভাত খাওয়াসহ বিকেলবেলা খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। সরকারি Ñবেসরকারি হাইস্কুলের প্রাথমিক ও কিন্ডারগার্টেন বিদ্যালয়গুলোতে পাঠদানের পর্ব দুপুর ২টার মধ্যে সমাপ্ত হয়ে থাকে। যার ফলে শিশুরা দুপুরে বাড়িতে এসে গোসল বা হাত মুখ ধুয়ে গরম ভাত খেয়ে নির্বিঘ্নে ৪টা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে পারে। এ বিশ্রাম ও ঘুমের ফলে বিদ্যালয়ে তাদের লেখাপড়ার ধকলের ক্লান্তি বা অবসাদ দূর হয়। তারা ক্লান্তিহীন ফুরফুরে মেজাজে বিকেল বেলা খেলাধুলা বিনোদনে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। এ মানসিক প্রশান্তি, শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সহায়তা করে থাকে।
বিদ্যালয়ে ক্লাসের সময়সূচির স্বল্পতা ও ৬-৭ টা ক্লাস শিক্ষার কষ্টের আরেকটি কারণ। ৫০/৪০/৩০/২৫ মিনিটের শ্রেণির কার্যক্রমে শিক্ষক শ্রেণিতে আসা যাওয়ার জন্য সময়, শিক্ষার্থীদের সঙ্গ দেয়া, নাম ডাকা, একটু দেখভাল করাসহ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতে পড়া বা কাজ দিয়ে তার দায়িত্ব শেষ করে থাকেন। অথচ শিক্ষায় উন্নত দেশগুলোতে বিদ্যালয়ই শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু। বাড়িতে বিনোদন, জ্ঞান অর্জনের নানা ধরণের পাঠ্যপুস্তকবর্হিভূত গল্প, ছড়া, কবিতা, নানা ধরনের আনন্দদায়ক বই পড়বে। সে লক্ষ্যে দৈনিক বিদ্যালয়ে ৪ পিরিয়ডের বেশি হওয়া যথার্থ নয়। প্রতিদিন সব পিরিয়ডে পাঠদানের নামে স্বল্প সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীকে যথাযথ জ্ঞান অর্জন থেকে বঞ্চিত করা কাম্য নয়, সে প্রেক্ষাপটে প্রতিটি পিরিয়ডের সময়সূচি কমপক্ষে ১ ঘন্টা করার বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন। যাতে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা বলা লেখা-দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষ থেকে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করে সুযোগ পায়। এতে বাড়িতে শিক্ষার্থীর পড়ার চাপ কমবে। এতে গৃহ শিক্ষক, কোচিং বা নোটগাইড থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট যুগের পর যুগ চলে আসছে। শিক্ষার মনোকষ্ট দূর করার প্রয়াসে শিক্ষক সংকট শূন্যে নামিয়ে আনা জরুরি।
শিক্ষকদের সঙ্গে কর্মকর্তাদের আচরণ বন্ধু সুলভ হওয়া কাম্য। কর্মকর্তাদের অনুধাবন করতে হবে, শিক্ষকতা দেশ ও জাতির কাছে সম্মানিত পেশা। প্রাথমিক শিক্ষকদের এক কথায় বলা যেতে পারে শিক্ষিত নাগরিকের জনক। মানুষ হিসেবে শিক্ষকদের চাওয়াÑপাওয়া, সুখ-দুঃখ, বেদনা থাকা স্বাভাবিক। এ চাওয়া, পাওয়া, সুখ-দুঃখের প্রতিক্রিয়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বা বিভিন্নভাবে প্রকাশ করা বিধিলঙ্ঘন করে না। তবে কারো মনে আঘাত দেয়া, রাষ্ট্র বা সরকার বিরোধী কার্যক্রম, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শিক্ষকরা কোনো অপরাধ করলে যাচাই-বাচাই, তদন্ত করে শাস্তি দেয়া কাম্য। তড়িঘড়ি করে যাচাই-বাচাই ,তদন্ত না করে শিক্ষদের মর্যাদার কথা বিবেচনা না করে তাদের প্রাথমিক ভাবে অপরাধী সাব্যস্ত করে সাময়িক বরখাস্ত করার বিষয়টি পীড়াদায়ক। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।
কয়েকমাস পূর্বে জাতীয় পর্যায়ে সেরা দুইজন শিক্ষক, তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে জাতীয় পুরস্কার গ্রহণ করতে না পারায় মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। জাতীয় পুরস্কার দিয়ে খানিকটা যাচাই-বাচাই তদন্ত না করে সাময়িক কর্মচ্যুতির আদেশ অনেকটা অমানবিক।
তদন্ত করে পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে চার্জ না আনতে পেরে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অনেকটা ‘জুতা মেরে গরুদান’ প্রবাদের মতো মর্যাদাহানি করা হয়েছে। এ সাময়িক বরখাস্ত অপরাধ প্রমাণের আগে বিনা করাণে শাস্তি ভোগ করার মতো। এতে শিক্ষকের সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে। শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষকের পাঠদান থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চোর পুলিশের সম্পর্ক কাম্য নয়। শিক্ষকরা অপরাধ করলে অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হোক। তবে বিনা অপরাধে কোন শাস্তি কাম্য নয়। অসংখ্য সমিতির মাঝে ভেসে বেড়াচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ। তবে তাদের মধ্যে নেই তেমন প্রতিবাদ। আছে শুধু কর্তাব্যক্তিদের তোষামোদি। প্রতিবাদী নেতাবিহীন সংগঠন বিধায় শিক্ষকদের কপালে রয়েছে চরম অশান্তি। দেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা আজ দীর্ঘদিন পর প্রধান শিক্ষক পদে পদোন্নতির অপেক্ষারত। কিন্ত ঢাকা শহরের শিক্ষকরা পদোন্নতি ও তাদের পোষ্য কোঠায় সন্তানদের চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে। সারা বছর নিয়মনীতি বহির্ভূত ভাবে ঢাকার বাহির থেকে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক বদলি হয়ে ভরপুর হয়ে, তাদের পদোন্নতি ও সন্তানদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
শিক্ষা, শিক্ষার্থী, পোষ্য, শিক্ষক তথা প্রাথমিক শিক্ষার মনোকষ্ট দূর করার জন্য আর্থিক সংশ্লিষ্টতার প্রয়োজন নেই। দরকার শুধু মানসিকতা। স্বতন্ত্র প্রাথমিক শিক্ষা ক্যাডার, সহকারী শিক্ষকদের এন্টি পদ ধরে শতভাগ পদোন্নতি, হাইস্কুল-কলেজের প্রাথমিক শাখা বিলুপ্ত, যত্রতত্র বেসরকারি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও এবতেদায়ি মাদরাসা স্থাপনের ওপর কঠোর বিধি নিষেধ, বিদ্যালয় সময়সূচি দুপুর ২টা মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের গরম ভাত খাওয়া, খেলাধুলা ও বিনোদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা। শিক্ষক সংকট শূন্য সহিষ্ণুতা নামিয়ে আনা। শিক্ষকদের অপরাধ প্রমাণের আগে সাময়িক বরখাস্ত বা কোন শাস্তি আরোপ না করা। দৈনিক ৪ পিরিয়ডে ১ ঘন্টা করে জ্ঞান অর্জন নিশ্চয়তা বিধান করা, নিয়মবর্হিভূত ভাবে ঢাকা শহরের বাহির থেকে শিক্ষক বদলি না করা। উপরোক্ত সমস্যা সমাধানে শিক্ষার মনোকষ্ট দূর করা প্রত্যাশা রইলো। জয় বাংলা।
লেখক: সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ