শিক্ষক দিবসের ভাবনাশিক্ষার্থী ঝরে পড়া ঠেকাতে করণীয়

মোহাম্মদ আরিফ ইমাম |

করোনা সংক্রমণ সন্তোষজনক হারে কমে আসায় টানা দেড় বছর বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলেছে শিক্ষাঙ্গন। তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো অনেক শিক্ষার্থী আসছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। সরকারি তথ্য বলছে, সরকারি প্রাথমিকে ৮০ শতাংশ ও মাধ্যমিকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকছে। তবে বাস্তবে উপস্থিতির হার এর চেয়ে কম বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে। 

দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনেক পরিবারেই অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা বেড়েছে। অনেকেই শিশুশ্রমসহ অন্যান্য কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের হার সবচেয়ে বেশি কিন্ডারগার্টেন ও স্বঅর্থায়নে পরিচালিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে দেশের ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেনে ৮০ লাখ শিক্ষার্থী পড়ালেখা করলেও বর্তমানে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।  কিন্ডারগার্টেনে উপস্থিতির হার মাত্র ৩০ শতাংশ বলে জানা গেছে। শিক্ষার্থী সংকটে অনেক কিন্ডারগার্টেন এখনো খুলছে না।

ঝরে পড়ার উদাহরণ রয়েছে সাম্প্রতিক সরকারি তথ্যে। প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হিসাব করেই প্রাক-প্রাথমিক থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত বিনামূল্যের বই ছাপানো হয়। চলতি শিক্ষাবর্ষে সরকার ৩৫ কোটি ৯৩ লাখ পাঠ্যবই ছেপে বিতরণ করেছে। আগামী ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ৩৫ কোটি ১৬ লাখ ১৯ হাজার ৩১৩ কপি পাঠ্যবই ছাপার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। সেই হিসেবে ২০২২ শিক্ষাবর্ষে ৭৭ লাখেরও বেশি পাঠ্যবই কমছে। অথচ স্বাভাবিক সময়ে সাধারণত প্রতি বছরই শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়ে। শিক্ষার্থী বাড়ার কারণে বছরে গড়ে ২ দশমিক ৫ শতাংশ পাঠ্যবই বাড়ে। কিন্তু করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে এর উল্টোচিত্র দেখা হচ্ছে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিলো ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে করোনাকালে এই হার বেড়ে হয়েছে  ৪২ শতাংশ। গত ২ নভেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত জরিপটি চালানো হয়। দারিদ্র্যের মুখোমুখি ৫৬ শতাংশ পরিবার দাবি করেছে, করোনার সময়ে তাদের আয় কমেছে। ধার করে, সঞ্চয় ভেঙে এবং খাদ্য ব্যয় কমিয়ে এই সংকট মোকাবেলা করেছে তারা। যেখানে ধার করে সংসার চালাতে হচ্ছে, সেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো শিক্ষার ব্যাপারটি মাথায়ই রাখতে পারছে না। এসব পরিবারের অনেক সন্তান শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে যারা আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আর নাও ফিরতে পারে।

শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া ঠেকাতে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার কারণ ও প্রতিকার অন্বেষণ করতে হবে। প্রতিষ্ঠান প্রধানকে প্রতিটি শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার কারণ উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন উপজেলা-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যে বয়সী শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার প্রবণতা বেশি তাদের বিশেষ কাউন্সিলিং প্রোগ্রামের আওতায় আনা জরুরি। শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আরও আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় করা যেতে পারে। এছাড়াও সরকারের বিদ্যমান ব্যবস্থাপনা যেমন,  বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ, শিক্ষাবৃত্তি কর্মসূচির পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রণোদনাসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে, যেন দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের পড়াশোনার খরচকে কোনোভাবেই বোঝা মনে না করে। 

প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে অভিভাবক সমাবেশ করে শিক্ষা বিষয়ক কাউন্সিলিং জোরদার করতে হবে। শ্রেণি কার্যক্রমে শিক্ষকদের আরও আন্তরিক হতে হবে। শিক্ষার্থীরা যেহেতু দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীরে শ্রেণি কার্যক্রমের বাইরে তাই কঠোরতা পরিহার করে আনন্দদায়ক শিখন-শেখানো পদ্ধতি অনুসৃত হওয়া বাঞ্ছনীয়। পাঠের বিষয়বস্তু সহজবোধ্য ও উপভোগ্য করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীদের মাঝে তা একঘেঁয়ে মনে না হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খেলাধূলা ও বিনোদনমূলক কার্যক্রমের ওপর জোর দিতে হবে। যেসব শিক্ষার্থী সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না তাদেরকে বৃত্তিমূলক কারিগরি শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের হোম ভিজিট কার্যকর করতে হবে। মাদরাসার ইবতেদায়ি শিক্ষার্থীদের সরকারি প্রাথমিকের অনুরুপ সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। সর্বোপরি, শিক্ষাব্যবস্থা যাতে ভীতিকর না হয়ে আগ্রহের বিষয় হয় সেদিকে শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। 

লেখক : মোহাম্মদ আরিফ ইমাম, প্রভাষক ও দপ্তর সম্পাদক, বাংলাদেশ মাদরাসা জেনারেল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন, কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.005256175994873