ছয় দিনের ব্যবধানে ঘটে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের তিন মেধাবী শিক্ষার্থীর অস্বাভাবিক মৃত্যু। দুর্ঘটনা বা হত্যাকাণ্ড নয়, তারা নিজেরাই নিজেকে শেষ করেছেন, বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। কেন এই মেধাবীরা আত্মহত্যা করছেন, তা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাউন্সেলিং ব্যবস্থা নিয়েও উঠেছে বড় প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কারণগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে মেধাবীরা নিভৃতে শেষ হতেই থাকবে। বাবা-মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ, শিক্ষকের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্যের সেবা বৃদ্ধি করা এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে আত্মহত্যা করা তিন শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী জয়া কুণ্ডু।
তার সহপাঠী ও রুমমেটরা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে সে চুপচাপ থাকত। অর্থ সংকটে ছিল, দুবার সেমিস্টার পরীক্ষায় অংশ নেয়নি। হয়তো হতাশা থেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় সে। তিনটি ঘটনাতেই সহপাঠী ও স্বজনের সঙ্গে কথা বলে এ আত্মহননের পেছনে হতাশার বিষয়টি সামনে এসেছে; কিন্তু শিক্ষার্থীরা কেন হতাশ হচ্ছেন—তা নিয়ে কেউ ভাবেন না। হতাশা হলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যায়ে কাউন্সেলিংয়ের বিষয় থাকলেও সেই প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রায় অকেজো। সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, শুধু ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫৩২ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অন্তত ৮৬ শিক্ষার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ১০১ জন, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৪২, ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ৫৬ শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন। এই হিসাবে বছরে ৭১ জনের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন ইনার ফোর্সের প্রধান নির্বাহী মনোবিজ্ঞানী ফরিদা আকতার বলেন, অনেকেই ভেবে থাকেন, ভালো রেজাল্ট প্রাতিষ্ঠানিক মেধা যাচাইয়ের একমাত্র মানদণ্ড; কিন্তু আসলে তা নয়। এই বিষয়টি নির্ভর করে যৌক্তিক চিন্তা, যে কোনো কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করার যোগ্যতা এবং যে কোনো বিষয় বিশ্লেষণের চেষ্টার ওপর; কিন্তু যেসব শিক্ষার্থীকে এসব যোগ্যতা অর্জন করানো যাবে না, তারা প্রতিকূল পরিবেশে ভেঙে পড়বেই। এই মনোবিজ্ঞানী বলেন, আবেগের নেতিবাচক ব্যবহার এবং হতাশার চূড়ান্ত গন্তব্য হলো আত্মহনন। কারণ, তাদের আবেগ সঠিকভাবে বিকশিত হয়নি। এক্ষেত্রে সমাজ এবং পরিবারের দায় সবচেয়ে বেশি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও শিক্ষকদের সেসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসক বা কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যেতে হবে।আত্মহত্যার কারণ ও তার প্রতিকারবিষয়ক গবেষক ও ইস্টওয়েস্ট ইউনিভিার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক ড. আনিসুর রহমান খান বলেন, আত্মহত্যা যে শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে হচ্ছে তা নয়, সব ধরনের মানুষের মধ্যেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার বিষয়টি আমাদের মধ্যে খুব আলোড়ন সৃষ্টি করে, কারণ তারা হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিকীকরণ বলতে যে জিনিসটা রয়েছে, সবার সঙ্গে মেশা, কথা বলা—সেই জিনিসটা প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা ধীরে ধীরে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। তাদের মানসিক ব্যাপারগুলো কারও সঙ্গে বলতে পারছে না। জীবনটা তারা শুধুই তাদের কেন্দ্রিক করে ফেলছে। এসব কারণ অভিভাবক, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবতে হবে।
আত্মহত্যার সঙ্গে বেকারত্বের একটি পুরোনো যোগসূত্র রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ জিনিসটা থেকে শিক্ষিত যুব সমাজকে বের করে আনার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে আরও অনেক কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া দরকার।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে দায়িত্ব পালন করা বেসরকারি সংস্থা সোসাইটি ফর ভলান্টারি অ্যাক্টিভিটিসের (শোভা) নির্বাহী পরিচালক জাহিদুল ইসলাম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের চিকিৎসার জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা বিভাগ খোলার কথা আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলেছি। কারণ, শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে দুর্বল হলে নিজেকে একা ভাবতে শুরু করে। তখন নিজের জীবন শেষ করে দেওয়ার মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। তিনি বলেন, কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করছে; কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে এখনো সচেতন নয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম থাকলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক কম।