সরকারি-বেসরকারি একাধিক গবেষণার তথ্য থেকে দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের যতোটুকু শেখার কথা, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী তা শিখতে পারছেন না। ফলে, এই পর্যায়ে যতোটুকু দক্ষতা অর্জন করার কথা, তা না করেই অনেক শিক্ষার্থী ওপরের শ্রেণিতে উঠছে। এই ঘাটতি পূরণ না হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পরও পরবর্তী পর্যায়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। যার প্রমাণ আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় দেখতে পাই, উচচশিক্ষা শেষে চাকরির বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে দেখতে পাই। প্রথম শ্রেণি থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজি বাধ্যতামূলক। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পরও বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজিতে ভাষাগত দক্ষতায় দুর্বলই থেকে যাচ্ছেন। গণিত, বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিষয়ে অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের চরম দুর্বলতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এসবের কারণ অনুসন্ধানে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সংস্থা, ব্যক্তি ছোটখাট সমীক্ষা ও গবেষণা পরিচালনা করে থাকেন যেগুলোর ফল নীতিনির্ধারকদের জন্য সচেতনতা বাড়াতে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু তারা এগুলো কতোটা দেখছেন এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন সেটি একটি বড় প্রশ্ন।
কভিড পরবর্তীকালে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরাতে গঠিত ‘নিরাপদ ইশকুলে ফিরি’ ক্যাম্পেইন নতুন নামে যাত্রা শুরু করেছে। এ ক্যাম্পেইন সবার জন্য একীভূত ও মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে কাজ করবে। কোভিড মহামারি চলাকালে ২০১৯ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পরিচালিত বিভিন্ন জাতীয় প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এবং বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা, নৃতত্ত্ব জাতিসত্তা, অর্থনৈতিক অবস্থা, স্কুল ও ভৌগলিক বৈচিত্র ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে মূলত সাম্যতা ও একীভূত শিক্ষার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার জন্য একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণা কার্যক্রমে সারা দেশের ৯টি জেলা থেকে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ‘নিরাপদে ইশকুলে ফিরি’ ক্যাম্পেইনের সদস্য সংস্থা’ ব্র্যাক বিদ্যালয়ে উপস্থিতি বিষয়ে একটি গবেষণাটি পরিচালনা করে। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিলো কোভিড মহামারি শেষে বিদ্যালয়গুলো ফের খোলার পার ২০২১-এর উপস্থিতির তুলনায় ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতির হার মূল্যাযন করা। বাংলাদেশের ছয়টি বিভাগের ২৬৮টি বিদ্যালয় থেকে একটি জরিপের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে মোট বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিলো ৩২৮টি। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এ সংখ্যা ছিলো ২৬৮টি। উভয় জরিপে মোট তিন সপ্তাহের উপস্থিতির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিলো। জরিপে দেখা গেছে, ২০২২-এ সামগ্রিক উপস্থিতির হার আগের বছরের (২০২১) তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। উভয় বছর চতুর্থ এবং নবম শ্রেণিতে উপস্থিতি কম ছিলো যা পঞ্চম শ্রেণি এবং দশম শ্রেণিতে ভর্তির আগে ঝরে পড়ার হারকে নির্দেশ করে। ২০২২-এ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন উপস্থিতি চতুর্থ শ্রেণিতে (৮৩ শতাংশ)। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন উপস্থিতি নবম শ্রেণিতে ৬৬ শতাংশ, যা ২০২১-এ ছিলো ৫৭ শতাংশ। ২০২২-এ ছেলে-মেয়ে উভয়ের সামগ্রিক উপস্থিতি বেড়েছে। তবে, ২০২১-২২ উভয় খ্রিষ্টাব্দেই মেয়েদের সামগ্রিক উপস্থিতি ছেলেদের তুলনায় বেশি। চতুর্থ শ্রেণিতে ৮১ শতাংশ বনাম ৮২ শতাংশ। পূর্ববর্তী বছরের (২০২১) তুলনায় ২০২২-এ গ্রামীণ এবং শহরাঞ্চলে সামগ্রিক উপস্থিতি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় ধরনের বিদ্যালয়ে বেড়েছে। তবে নবম শ্রেণিতে শহরের উপস্থিতি কমেছে।
বেসরকারি সংগঠন ওয়েব ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী এক হাজার ৫০০-এর বেশি শিশুর ওপর অন্য এক জরিপ চালানো হয়। ১৪ জুন প্রকাশিত ওই জরিপের তথ্য বলছে, ১০ শতাংশের বেশি ছেলে ও প্রায় ৯ শতাংশ মেয়ে বাংলায় বর্ণই পড়তে পারেনি। ইংরেজিতে এই হার আরো বেশি। ইংরেজিতে বর্ণ পড়েত পারেনি ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ ছেলে ও ৫৩ শতাংশ মেয়ে। আর ইংরেজিতে গল্প পড়তে পারেনি প্রায় ৮৫ শতাংশ ছেলে ও প্রায় ৮৩ শতাংশ মেয়ে। গণিতে একক অঙ্ক শনাক্ত করতে পারেনি ৯৬ শতাংশ ছেলে ও ৯৭ শতাংশের বেশি মেয়ে। বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ৭৫১ ছেলে ও ৭৮২ মেয়ে শিশুর ওপর এই জরিপ চালানো হয়েছে। ৫ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রান্তিক শিশুদের বাড়িতে গিয়ে মূল্যায়ন করা হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বইয়ের বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়। এই জরিপের কিছুদিন আগে সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, করোনার আগে ২০১৯ সালে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ইংরেজিতে শিখন অর্জনের গড় হার ছিলো প্রায় ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ তখনই প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী যা অর্জন করার কথা ছিলো, তা করতে পারেনি। এখন এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৬ শতাংশে। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানের আগের তুলনায় অবনতি হয়েছে। গবেষণা পদ্ধতি অনুযায়ী সাম্প্রতিক সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, প্রাক কোভিড এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে সক্রিয় অংশগ্রহণের হার প্রাথমিক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরে ছিলো ৮০ শতাংশের বেশি। একইভাবে মূল গবেষণা তথ্য সংগ্রহ করেও দেখা গেছে যে, করোনার সময়ে অংশগ্রহণের হার ছিলো ৮০ শতাংশ। ২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ছিলো ৮৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিকে ৭৫ শতাংশ। শহর গ্রাম, চর-হাওর এবং নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের শতাংশের হারও প্রায় একই ছিলো। বিভিন্ন শিখন মাধ্যমে বিভিন্ন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করতে পারার তথ্যে দেখা যায় যে, ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী টিভিভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। শুধু ৫৭ শতাংশ আংশিকভাবে ওয়েবভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে পেরেছে। গবেষণালব্ধ তথ্যের শতাংশের হার, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত জাতীয় প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যের শতকরা হারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থী জটিল বাক্য ও শব্দ পড়তে পারেন না। এসব গবেষণার তথ্য বলছে, বড় ধরনের দক্ষতার ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। মাধ্যমিকে গিয়েও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ইংরেজি ও গণিতে দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে থাকে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট অব সেকেন্ডারি স্টুডেন্ট যা মাধমিক শিক্ষার্থীদের জাতীয় মূল্যায়ন, এই প্রতিবেদনেরর তথ্য বলছে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থীর ইংরেজিতে অবস্থা খারাপ। একই শ্রেণিতে গণিতে ৪৩ শতাংশের অবস্থা খারাপ বা গড়পড়তা। বিভিন্ন শিখন মাধ্যমে অংশগ্রহণের বিষয়ে শহরের শিক্ষার্থীরা গ্রামের শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি অংশগহণ করতে পেরেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরেই ছাত্ররা ছাত্রীদের চেয়ে অংশ্রহণের বেশি সুযোগ পেয়েছে। আরো দেখা গেছে বিভিন্ন প্লাটফর্মে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রক্রিয়ায় অনেক চ্যালেঞ্জ ছিলো। যেমন-টেলিভিশন, কম্পিউটার, আধুনিক মোবাইল ফোন প্রভৃতি উপকরণের ঘাটতি, কোভিড পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব, ইন্টারনেট সংযোগ এবং আর্থিক সমস্যা। ছাত্রীদের কম অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিলো গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ততা, বাল্যবিয়ে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। এ ছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিক উভয় স্তরেই কোভিড-১৯ চলাকালীন বিকল্প শিখন মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার হার ছিলো ৮০ শতাংশের বেশি। শিখন প্রাক্রিয়াতে অংশগ্রহণ ও শিখনে সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাড়িতে, স্কুলে এবং পাড়া-প্রতিবেশী থেকে পাওয়া সহায়তার হার ছিলো ৫০ শতাংশের বেশি। করোনাকালীন শিখন মাধ্যমে ৭০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী স্কুলে অনুপস্থিত ছিলো এবং ছাত্রীরা বাড়িতে সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে যা কোভিড পরিস্থিতিতে শিখন কার্যক্রমের বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখযোগ্য।
সাম্যতা ও একীভূত শিক্ষার ক্ষেত্রে গবেষনায় পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে যে, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধিতা সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের জন্য এই বিকল্প মাধ্যমে শিখন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ও শিখনের বিষয়টি ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। যেমন-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা কোভিড-১৯ এর পরিস্থিতিতে বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার হয়েছে বলে তাদের জন্য বিকল্প শিক্ষার কার্যক্রমে অংশ নিতে সুবিধাজনক হয়েছে। শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শিখন মাধ্যমগুলোতে অংশগ্রহণ ও প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক ছিলো, যা শারীরিক চলাচলের মাধ্যমে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকতো। লিখতে ও পড়তে প্রতিবন্ধিতা আছে এমন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও কোভিডকালীন বিকল্প শিখন মাধ্যমগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। বিভিন্ন সহায়ক প্রযুক্তিগুলোর ইতিবাচক ব্যবহার শিক্ষার্থীদের পড়ার দক্ষতার পাশাপাশি সাক্ষরতা ও গাণিতিক দক্ষতাও উন্নত করেছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিখন অর্জন নির্দেশক তথ্যগুলো বিবেচনা করে দেখা গেছে যে, শিখন ঘাটতি শুধু কোভিড মহামারিজনিত কারণে নয়, বরং শিক্ষাব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে শিখন ঘাটতি পূরণে শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তরে জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সম্পর্কিত জরুরি অবস্থায় পরিচালনার জন্য সুনির্দিষ্ট গবেষণা কাঠামো প্রয়োজন। বিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রমে ফলপ্রসূভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য নমনীয় ও শিথিলযোগ্য ব্যবস্থাপনার নীতিমালা প্রয়োজন। ডিজিটাল বৈষম্যকে চিহ্নিত করে প্রবেশগম্যতার ক্ষেত্রে ডিজিটাল সাক্ষরতা এবং ইন্টারনেট ও ডিজিটাল যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ সুবিধা তৈরি করা প্রয়োজন। এ ছাড়া, শিখন ঘাটতি দূর করার জন্য স্থানীয় ও ব্যক্তিগত পর্যায়েও উদ্যোগ নিয়ে শিক্ষার্থীদের শ্রেণি অনুযায়ী দক্ষতা অর্জনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ টিম
দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা