স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুণগত ও আচরণগত কিছু পার্থক্য থাকতেই হয়, তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয় কথাটির কোনো মানে থাকে না। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই আবেগের বশবর্তী হয়ে করতে পারেন, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের করা উচিত নয়। তাদেরকে মনে করা হয় অধিকতর সচেতন, দায়িত্ববোধসম্পন্ন, নিজেদের প্রতি, প্রতিষ্ঠানের প্রতি এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি তারা প্রকৃত অর্থেই দায়িত্ববান। জাতির কোনো দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে তারা এগিয়ে আসেন। এ ধরনের গৌববোজ্জল ইতিহাস তারা বহুবার তৈরি করেছেন এবং সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট আন্দোলনেও আমরা তা প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু সামান্য কারণেই, নিজেদের স্বার্থের জন্য যখন তখন জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাজ নয়।
এখানে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার একটি বড় মৌলিক পার্থক্য থাকা প্রয়োজন। এই শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তাদের প্রথমেই পেতে হবে যে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করার অধিকার তাদের নেই। জাতীয় কোনো বৃহত্তর স্বার্থে বা কোনো বিশেষ মুহূর্তের কথা আলাদা। ইদানিং আমরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় দেখতে পাচিছ সামান্য দাবি দাওয়া নিয়ে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভন্তরীণ কোনো সমস্যা নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে সমস্ত যান চলাচলা বন্ধ করে দিয়ে সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগে ফেলছেন। তাদের এসব দাবি দাওয়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, কোনো সংযোগ নেই, কোনো স্বার্থ নেই, কোনো বিরোধ নেই অথচ তারা অযথাই ভিকটিম হচ্ছে। অর্থাৎ জনগণকে বিপদে ফেলে তাদেরকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় যেনো দিন দিন মামুলী বিষয়ে পরিণত হচেছ। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের অত্যন্ত দায়িত্বশীল, অত্যন্ত রিজন্যাবল আচরণ প্রদর্শন করতে হবে, তা না হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার কি মূল্য রইলো?
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্ট কলেজে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করি। তখন ওই ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এনায়েত হোসেন, একজন শিক্ষানুরাগী সেনা কর্মকর্তা। ঘাটাইল ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন এলাকা থেকে শিক্ষার্থীরা আসতেন। তারা মাঝে মাঝে মিটিং-এ ব্রিগেড কমান্ডারকে বলতেন যে, ক্যান্টনমেন্টের সামনের রাস্তায় যাতে স্পিড ব্রেকার দেয়া হয় কারণ তারা বিভিন্ন এলাকা থেকে বাসে এসে ক্যান্টনমেন্টের সামনে নামেন এবং তারপর কলেজে আসেন, কিন্তু সব বাস ভালভাবে থামেনা, তাই ব্রেকার দরকার। উত্তরে কমান্ডার বলেছিলেন, মহাসড়কে স্পিড ব্রেকার দেয়া আইনসিদ্ধ কোনো কাজ কাজ নয়। শিক্ষার্থীদের এই সামান্য কারণে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়া শিক্ষার্থীদের কাজ নয়। একটি ক্যান্টনমেন্টের সামনে স্পিড ব্রেকার দেয়া তাদের জন্য অত্যন্ত সহজ কাজ। কিন্তু তিনি বললেন যে, মহাসড়কে এটি করা ঠিক নয়। তরুণ প্রভাষক হিসেবে একজন দক্ষ সেনা অফিসারের রাষ্ট্রের নিয়ম কানুনের প্রতি এবং বিশেষ করে সাধারণ মানুষের কোনো ধরনের যাতে সমস্যা না হয় সেটির প্রতি সহানুভূতি দেখে অভিভূত হয়েছিলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দেখেছি, শিক্ষার্থীরা সামান্য কোনো কারণে মহাসড়কে বাসের হেল্পার, কন্ডাকটর কিংবা ড্রাইভারদের সঙ্গে ঝগড়া ফ্যাসাদ বাঁধিয়ে পুরো রাস্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি সারাদিন বন্ধ করে রাখতেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর, যিনি একজন শিক্ষক যার সঙ্গে বাসের হেলপার, কন্ডাকটর, ড্রাইভার কিংবা মালিকের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মারামারি করে এসে প্রক্টরের পদত্যাগ, তার অফিস তছনছ করা, এমনকি তার বাসায় হামলা করার মতো ঘটনাও ঘটাতেন। এসব ঘটনা যেনো ইদানিং আরো বেড়ে গেছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মানেই হচ্ছে সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানো কিংবা ক্ষমাত দেখানোর এক ধরনের ইচ্ছে। তাদের ভয় না পেলে যেনো উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হওয়া যায় না।
শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো- সাধারণ মানুষের কষ্ট বুঝতে পারা, দেশের পরিস্থিতি বোঝা। কিন্তু অত্যন্ত সহজভাবে সামান্য একটি দাবি আদায়ের জন্য তাদের প্রতিষ্ঠানের সামনের রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের, শিশু নারীদের অবর্ণনীয় দুঃখ যাতনার মধ্যে ফেলে দেয়ার মধ্যে কোনো ধরনের যুক্তি কিংবা বাহাদুরি নেই। সাধারণ মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেখলে শ্রদ্ধার মাথা নত করবেন, তারা উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ দেখে নির্ণয় করবেন যে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ছাত্র নেতা, শিক্ষক, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ সবাইকে বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলোচনা করতে হবে তা না হলে উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা দিন দিন খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছে। এটি হতে দেয়া যায় না।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আরো দেখেছি, একজন শিক্ষার্থী যতসময় ধরে ব্রাশ কিংবা সেভ করেন ততোক্ষণ পর্যন্ত পানির টেপ খোলা রাখেন। অর্থাৎ শুধু সেভ করার জন্য একজন শিক্ষার্থী কয়েক শ’ থেকে কয়েক হাজার লিটার পানি নষ্ট করেন। কোনো কারণে পানি কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হলে প্রভোস্ট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ার, তাদের বাড়ি কিংবা বাড়িতে হামলা করা হয়। অথচ এইসব শিক্ষার্থীদের অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষে ঢাকায় মেসে থাকেন চাকরি খোঁজার জন্য, তখন এক ঘটি পানি দিয়ে সেভ, বাথরুম সারেন এবং দুদিনেও হয়তো গোসল করার মতো পানি পান না। শিক্ষার্থীদের দেশ ও সমাজ না বুঝলে শুধু আত্মম্ভরিতা দেখালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পন্ন হয় না। তাই উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীর প্রতি অনুরোধ করছি কথায় কথায় রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেয়ার মধ্যে কোনো ক্রেডিট নেই। কর্তৃপক্ষ কিংবা সরকারকে জানানোর জন্য অন্য কোনো পন্থা, নতুন কোনো পন্থা আবিষ্কার করুন যা সাধারণ মানুষকে কষ্টে ফেলবে না। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করার অধিকার কারোর নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে এ ধরনের আচরণ তো কোনোভাবেই আশা করা যায় না।
উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষাই হওয়া উচিত যে, তাদের কোনো দাবি-দাওয়ার জন্য কোনোভাবেই সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেয়া যাবে না। পাবলিক প্লেসে কোনো ধরনের ঝামেলা পাকিয়ে হাজার হাজার মানুষকে কষ্ট দেয়ার কোনো অধিকার তাদের নেই। হ্যাঁ জাতীয় কোনো ইস্যুতে এটি জীবনে এক দুবার হতে পারে, কিন্তু সেজন্যও সাধারণ মানুষের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এই বলে, এ ছাড়া তাদের আর কিছু করার ছিলো না।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক