শিক্ষার্থীদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে দেশপ্রেম

মো. নজরুল ইসলাম |

বেশ ক’বছর ধরে অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে দেশ ত্যাগের একটা হিড়িক পড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। এ দেশে থেকে প্রতিষ্ঠিত হবার কোনো সুযোগ নেই তাই যে যেমন পারো, কেটে পড় ইউরোপ বা আমেরিকায় এমন একটা কথা যেনো প্রায় বেদ-বাক্যের মতোই সমাজে প্রচলিত হয়ে গেছে।

শুধু শিক্ষার্থীরাই নয় বরং সচেতন অভিভাবকমহলও ওই একই সুরে কথা বলছেন এবং তাদের আদরের সন্তানটিকে যে কোনোভাবে পাঠিয়ে দিচ্ছেন উচ্চতর শিক্ষার জন্য সুবিধাজনক কোনো দেশে। আর যারা একবার চলে যাচ্ছেন, তারা পড়াশোনা শেষ করে আর দেশে না ফিরে বরং সেখানেই ছোটখাটো কোনো কাজ নিয়ে থেকে যাবার চেষ্টা করছেন। এমনকি অনেকে সেই দেশের নাগরিকত্ব লাভেরও চেষ্টা করছেন। দেশের প্রতি যে মায়া, শেকড়ের যে টান সেটি নুতন প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত। 

ইদানীং দেশপ্রেম শব্দটিও যেনো তাদের কাছে অত্যন্ত সেকেলে মনে হয় এবং বিদেশের মাটিতে গিয়ে ‘আমি বাংলাদেশি’ এমন পরিচয় দিতেও অনেকে কুণ্ঠা বোধ করছেন। অথচ নিকট-ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ভিন দেশের অনেক সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে দেশের মাটিতে ফিরে এসে দেশের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন এ দেশেরই অসংখ্য দেশপ্রেমিক সন্তান।

জন্মভূমির প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমাদের দামাল ছেলেরা। আধুনিক প্রজন্মের জন্য শিক্ষার উদ্দেশে দেশপ্রেমের জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে ইতিহাস থেকে নেয়া একটি  মর্মস্পর্শী নাটকীয় ঘটনার অবতারণা করা হলোঃ

 ‘’নিকাল যাও, ছোটে, নিকাল যাও’ (Get lost, younger brother). ‘নেহি ভাইয়া, নেহি  I cannot get back vaia, I am a true soldier, I cannot play traitor with my own country, and rather, you hit me.’ আর তখনই বড়ভাই মেজর সাহেব জাদা ইউনুস খানের পিস্তল গর্জে উঠলো সহোদর ছোটভাই মেজর সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের বক্ষদেশ লক্ষ্য করে। রহস্যজনকভাবে ইন্ডিয়ান মেজর ইউনুস খানের তাক করে রাখা সাব-মেশিনগান থেকে নয় বরং ত্বরিত গতিতে কোমর থেকে বেরিয়ে আসা পিস্তলের গুলি ছুটলো পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে অবস্থিত ছোটভাইয়ের বুক লক্ষ্য করে।

আবার মেজর ইয়াকুবের অস্ত্রটি ইউনুসের দিকে তাক করা থাকলেও ইয়াকুবের আঙুল সেটির ট্রিগারে চাপ দেয়া থেকে বিরত থাকলেন। ব্রিটিশ বাহিনীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দুই মেজর, দুই ভাই আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন শত্রু হিসেবে, দেশের শত্রু। মেজর ইউনুসের ছোড়া গুলি কিন্তু মেজর ইয়াকুবের বক্ষ ভেদ করলো না, বরং অস্ত্র ধরে রাখা হাতের কবজি ভেদ করলো আর হাতের অস্ত্রটি ভূলুণ্ঠিত হলো। আহত সৈনিককে আঘাত করা বীরের কর্তব্য নয়, ইউনুস চলে গেলেন, আর চিকিৎসকদল আহত ইয়াকুবকে নিয়ে গেলো তাদের শিবিরে। তারপর কী ঘটেছিলো ইতিহাসের একনিষ্ঠ পাঠক মাত্রেই জানেন। ’৪৭ এর দেশ ভাগ শুধু ভূখণ্ডকেই ভাগ করেনি, ভাগ করেছিলো পরিবারের সদস্যদেরকে এবং তাদের হৃদয়কে। কেনো এই বিভক্তি? 

মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী নামক বৃদ্ধ ছোট পাখিটি আর চাপ নিতে পারছিলেন না, জিন্নাহর চাপে এবং জওহরলালের মৃদু সম্মতিতে তিনিও সম্মত হলেন ভারত-মাতার অঙ্গচ্ছেদনে। ১৪ আগস্ট ভারত-ভূমিতে উদিত হলো দ্বিখণ্ডিত সূর্য। ভারত-মাতার মুক্তির জন্য যিনি নিজ-জীবনের ভোগবিলাস ত্যাগ করে আজীবন সংগ্রাম করে গেলেন তাকেই কি না উগ্র, কট্টরপন্থি সাভারকর গং দেশদ্রোহী, বিশ্বাসঘাতক ইত্যাদি নামে কলঙ্কিত করলো। গান্ধী বলেছিলেন, ভারত ভাগ হবে আমার লাশের ওপর দিয়ে। তা-ই হয়েছিলো সামান্য একটু ব্যতিক্রম ছাড়া।

ভাগ-বণ্টন কার্যটি সম্পন্ন হবার পর ’৪৮ এর ৩০ জানুয়ারি, পড়ন্ত বিকেলে তার কোমল বুক লক্ষ্য করে নাথুরাম গডস এর পিস্তল গর্জন করলো পরপর ৪ বার, বাপুজি পড়ে গেলেন আভা আর মনুবেন–এ দুজনার মাঝখানে। রাম নাম জপতে জপতেই তিনি চোখ বুঁজলেন। সেদিনকার ভারত ভূমির সূর্য অস্তমিত হলো সিন্ধুপারে, নেমে এলো ঘুটঘুটে আঁধার। রক্তমাখা গান্ধীর নিষ্প্রাণ দেহ কোলে নিয়ে বসে রইলেন নির্বাক জওহরলাল নেহরু। নেহরু আরেকবার পিতৃহারা হলেন। 

মুসলিম লেবাসধারী জিন্নাহ এর দ্বিজাতিতত্ত্ব কিন্তু হালে পানি পেলো না। তার কল্পিত শান্তির ঘরে তুষের অগ্নি প্রজ্বলিত হয়ে ধিকিধিকি জ্বলতে থাকলো। তীক্ষ্ম মেধাসম্পন্ন কপোট এই লোকটির অনেক গুণ ছিলো এটা অস্বীকার করবার উপায় নেই। শুকরের মাংস সহযোগে রুটি-মদ গেলা আর পার্সি রমণীর পানি গ্রহণ কিন্তু এই গুণের মধ্যে পড়ে কি না তা পাঠকের বিবেচ্য। কেউ কেউ তাকে Broad minded hero আখ্যায়িত করলেও বিশিষ্ট জনের ভাষ্য, ‘Jinnah had many good qualities, but freedom from communal bigotry was not one of them. The fact that Jinnah drank whisky, enjoyed bacon and sausages, and married a Parsi doesn’t make him liberal–it just makes him a hypocrite.’ 

’৪৭ এর দেশ ভাগে এমন অনেক পরিবারের কয়েকজন চলে গেলো পাকিস্তানে, আর বাকিরা যারা বিশ্বাস করতো ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা, হিন্দুস্তান হামারা’ তারা থেকে গেল জন্মভূমি ভারতে, মাটির এবং নাড়ীর টানে। একই বাহিনীর দুই মেজর, দুই সহদোর ভাই, সাহেবজাদা ইউনুস খান এবং সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এভাবেই একজন ভারতে থেকে গেলেন, অপরজন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে চলে গেলেন সেখানে বাস করতে। এখন দুই ভাইয়ের দুই দেশ-ভারত ও পাকিস্তান। দুই ভাইই নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক। চাকরির শেষ পর্যায়ে বড়ভাই কর্ণেল এবং ছোটভাই মেজর জেনারেল পদ পেয়েছিলেন নিজ নিজ দেশে। ’৪৮ এর যুদ্ধে ভারত সরকার কাশ্মীর সীমান্তে মুসলিম সৈন্য প্রেরণের ফলে কথিত দুই ভাইকে মুখোমুখি হতে হয়েছিলো পরস্পরের শত্রু হিসেবে। ওপরে বর্ণিত ঘটনার মাধ্যমে তারা উভয়েই খাঁটি দেশপ্রেমিকের উদাহরণ তৈরি করে স্মরণীয় হয়ে আছেন আজও। 

’৬৫ এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিলো। বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিলো দেশপ্রেমের আরো একটি বাস্তব উদাহরণ। লেফটেন্যান্ট বেগকে পাকিস্তানি ব্রিগেড কমান্ডার দায়িত্ব দিলেন ভারতীয় ট্যাঙ্ক প্রতিরোধে কম্যান্ডো আক্রমণের জন্য। আদেশ মতো লে. বেগ রাতের আঁধারে আক্রমণ চালিয়ে ভারতীয় ট্যাঙ্ক-আরোহী মেজর এম এ আর শেখকে মাথায় গুলি করে তার কাঁধের অ্যাপুলেট এবং পকেটের আইডি কার্ড এনে হাজির করলেন ব্রিগেড কমান্ডারের কাছে। নিহত মেজরের পরিচয়-পত্র এবং র‍্যাঙ্ক-ব্যাজ দেখে খুশি হওয়ার পরিবর্তে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ওই ব্রিগেডিয়ার। লে. বেগ সবিনয়ে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার, আমি আপনার আদেশ যথাযথ পালন করেছি, আপনি খুশি হননি? আপনি কাঁদছেন কেনো? ব্রিগেড কমান্ডার ছলছল চোখে, ভাঙা কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘Young man, I have just realized from the evidence you have provided that I had tasked you to kill my younger brother. I hadn’t the foggiest idea that the 16 Cavalry was pitted against us. Major M.A.R Sheikh, whom you have killed was my younger brother’. পরমেশ্বরের অসীম কৃপায় ’৪৮ এ মেজর ইয়াকুব কাশ্মীর সীমান্তে বড় ভাইয়ের গুলি খেয়েও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন কিন্তু ’৬৫ তে ওই একই সীমান্তে বড় ভাইয়ের নির্দেশে ছোট ভাইকে চলে যেতে হলো এ গ্রহের ওপারে চিরতরে। 

সেই দেশ, সেই মাটি কেনো এখন নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করে না এমন প্রশ্নের জবাব খোঁজা অবান্তর। কেনো বদলে যাচ্ছে প্রজন্মের মনন-মানসিকতা? অত্যন্ত মেধাবি একজন শিক্ষার্থী বিভাগে প্রথম হয়েও চাকরি পাচ্ছে না, জীবন-জীবিকার তাগিদে হন্য হয়ে তাকে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে ছোট-খাটো যেকোনো একটি চাকরির জন্য। চাকরি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে যাদের মেধার কোনোই স্বাক্ষর নেই, আছে শুধু দলীয় পরিচয় অথবা তদবিরের জোর। যে দেশে মেধার মূল্য নেই, পরিশ্রমের দাম নেই, কেনো সে দেশের প্রতি নতুন প্রজন্ম আকৃষ্ট হবে? দেশ কেনো তার মেধাবী সন্তানদের হারিয়ে ফেলছে দিনের পর দিন, সে বিষয়ে ভাবতে হবে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের। প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিয়ে, মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করে, তবেই না তৈরি হবে সত্যিকার দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠী।    

লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়  

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029301643371582