প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার’ শ্লোগান দেওয়াকে অত্যন্ত দুঃখজনক বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাও লাগে না।
প্রধানমন্ত্রী সোমবার (১৫ জুলাই) সকালে তাঁর কার্যালয়ে আয়োজিত মন্ত্রণালয়/বিভাগসমূহের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ‘বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি (এপিএ) স্বাক্ষর’ এবং ‘বার্ষিক কর্ম সম্পাদন চুক্তি’ ও ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার’ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন।
এ সময় সরকারি কর্মচারীদের পত্রিকার লেখালেখিতে পাওয়ার কারণ নেই বলে আশ্বস্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা গত রোববার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল বের করেন। সেখানে তাঁরা ‘তুমি কে, আমি কে/ রাজাকার, রাজাকার’, ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ ইত্যাদি শ্লোগান দেন।
গতকাল প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেন, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী কীভাবে দেশে অত্যাচার চালিয়েছে তা তারা জানে না। এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জাবোধ হয়নি।
শেখ হাসিনা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হচ্ছে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। লাখো শহীদ রক্ত দিয়ে গেছেন, লাখো মা-বোন নির্যাতিতা, তাদের এই অবদান ভুললে চলবে না। এটা মনে রাখতে হবে। পাকিস্তানি হানাদার ও রাজাকার বাহিনী যেভাবে এ দেশে অত্যাচার করেছে, সেখানে আমার খুব দুঃখ লাগে, যখন শুনি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও বলে তারা রাজাকার।
তিনি বলেন, ‘তারা কী জানে ’৭১ এর ২৫ মার্চ কি ঘটেছিল সেখানে। সেখানে ৩শ’ মেয়েকে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এই দেশীয় দোসররা। ৪০ জন মেয়েকে পাকিস্তানি ক্যাম্পে ধরে নিয়ে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিল। তারা সেখানে কী অবস্থায় ছিলো? অনেক মেয়ে শাড়ি বা ওড়না দিয়ে ফাঁসি দিয়েছিল। তাদের কাপড় পড়তে দেওয়া হতো না। একটা পেটিকোট পরিয়ে বসিয়ে রাখতো। দিনের পর দিন তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতো।
সরকারপ্রধান বলেন, যখন তাদের উদ্ধার করা হয় মিত্র শক্তির এক ভারতীয় শিখ সৈন্য নিজের মাথার পাগড়ি খুলে এক মেয়ের গায়ে পরিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এটা কেবল একটা ঘটনা, এ রকম বহু ঘটনা রয়েছে।
শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান তুলে ধরে বলেন, আমাদের মেয়েরা বসে থাকত না। তাঁরাও কিন্তু কাজ করত। পিরোজপুরে এক মেয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর রান্নার কাজ করত এবং রাতে নদী সাঁতরে পার হয়ে চিতলমারী গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে হানাদারদের খবর পৌঁছে দিত। ধরা পড়ার পরে দুটি গাড়ির সঙ্গে তাঁর দুই পা বেঁধে টেনে–হিঁচড়ে খণ্ড–বিখণ্ড করে ফেলা হয়। এসব অত্যাচার, রাস্তায় রাস্তায় লাশ পড়ে থাকা এরা দেখেনি। তাই নিজেদের রাজাকার বলতে তাদের লজ্জা হয় না।
তিনি বলেন, হ্যাঁ, আমাদের গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে। এখানে কেউ শান্তি কমিটিতে ছিল, কিন্তু মানুষের ক্ষতি করেনি। কিন্তু যে বাহিনীগুলো তারা (পাকিস্তানি হানাদারেরা) তৈরি করেছিল, তাদের হাতে অস্ত্র দিয়েছিল এবং তাদের দিয়ে মানুষের ক্ষতি করতো, অত্যাচার, লুটপাট এবং গণহত্যা চালাত। তাদের বিরুদ্ধেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি, তাদের বিচার করে অনেকের ফাঁসিও দিয়েছি। এর মাধ্যমে তাদের দ্বারা যারা নির্যাতিত তারা ন্যায়বিচার পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে মুক্তিযুদ্ধ আমাদের গর্বের। জাতির পিতার একটি ডাকে এই দেশের মানুষ ঘর-বাড়ি পরিবার-পরিজন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে রণক্ষেত্রে চলে গেছে। জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধ করে বিজয় এনে দিয়েছে। আর যারা ওই বাহিনীতে ছিলো (রাজাকার-আলবদর-আলশামস) এই দেশের মানুষের ওপর অত্যাচার করেছে। সেটাতো ভুলে গেলে চলবে না।
তিনি বলেন, আমাদের সেই শিক্ষা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে। তাহলেই এ দেশ এগিয়ে যাবে এবং সেটা যে বাস্তবতা তার প্রমাণ ’৭৫ এর পর যারা ক্ষমতায় ছিলো ২১ বছর এবং পরে আরও প্রায় ৯ বছর, তারা দেশকে কিছুই দিতে পারেনি। কিন্তু আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করি এবং আমরা ভুক্তভোগীরা যখন ক্ষমতায় এসেছি, মাত্র ১৫ বছরে আজ বদলে গেছে বাংলাদেশ। বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত বাংলাদেশ। সেই দরদটুকু থাকতে হবে।
অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব ও সচিবগণ সম্পাদনকৃত এপিএ একে একে প্রধানমন্ত্রীর হাতে তুলে দেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এপিএ বাস্তবায়নে সাফল্য প্রদর্শনের স্বীকৃতি হিসেবে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে পুরস্কৃত করেন। সার্বিক মূল্যায়নে বিদ্যুৎ বিভাগ শীর্ষ স্থান লাভ করে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের শুদ্ধাচার চর্চায় উৎসাহ দিতে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ব্যক্তিগত পর্যায়ে প্রবর্তিত শুদ্ধাচার পুরস্কার ২০২৩-২৪ লাভ করেছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাহবুব হোসেন।
অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মসম্পাদন ব্যবস্থাপনা বিষয়ক একটি তথ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন স্বাগত বক্তৃতা করেন।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে আবারও কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চাই যেখানেই কোনো অনিয়ম দেখা দেবে, তার বিরুদ্ধে আপনারা যথাযথ ব্যবস্থা নেবেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ’জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করেছি। আর এই দুর্নীতি ধরতে গেলে আমাদের সরকারের ওপর দায়টা চাপিয়ে দেওয়া হয়। আমি এটা বিশ্বাস করি না। দুর্নীতি খুব কম লোকই করে কিন্তু তার বদনাম হয় খুব বেশি।’
প্রধানমন্ত্রী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে সবাইকে নজরদারি রাখার পাশাপাশি চক্রান্ত করে কেউ যেন খাদ্যের দাম বাড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ থাকার জন্যও সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্যও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বলেন তিনি।