বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের শিক্ষাখাতে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি, এ খাতে অর্জন-এসব বিষয়ে একেক শিক্ষাবিদ একেক রকম মতামত প্রকাশ করেন। এর মধ্যে কারো কারো মন্তব্যে থাকে হতাশার ছায়া।
আবার অনেকে যথেষ্ট আশাবাদী হওয়ার মতো মন্তব্যও করে থাকেন। অনেকদিন আগে এ-বিষয়ক কথোপকথনের একপর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেছিলেন, এ খাতে আমাদের আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আগামী দিনের বিশ্বে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকা কেন জরুরি এ সম্পর্কেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য তুলে ধরেছিলেন। বুধবার (২৭ জানুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, তিনি তার বক্তব্যের একপর্যায়ে বলেন, আমাদের দেশের অনেক গবেষক বিদেশে অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তাদের সাফল্যের খবর অনেকেই জানেন না।
ফলে তারা শিক্ষাখাতে আমাদের অগ্রগতি নিয়ে নানা ধরনের সংশয়ের কথা তুলে ধরেন। উদাহরণ হিসাবে অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, আমাদের দেশের এক মেধাবী গবেষক যুক্তরাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় যুক্ত রয়েছেন, তার নাম এম জাহিদ হাসান তাপস। আশা করা যায়, এ রকম মেধাবীরাই বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবেন।
ভবিষ্যতে কোনো মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এ বিজ্ঞানীর কাছ থেকে জরুরি কিছু জানার প্রয়োজন হতে পারে, এ বিবেচনায় এম জাহিদ হাসান তাপস নামটি আমার স্মৃতির নোটবুকে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। এ কথা বলা বাহুল্য, গবেষকরাও বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে দেশকে, এমনকি বিশ্ববাসীকে তাদের গবেষণালব্ধ জ্ঞানের আলোকে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকেন।
২.
আমরা প্রতিনিয়তই নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি; এসব সমস্যা মোকাবিলা করে এগিয়েও যাচ্ছি। এ নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। তবে কখনো কখনো ব্যতিক্রমী কোনো সমস্যাও আমাদের সামনে এসে হাজির হতে পারে, যার প্রভাবে কমবেশি সবারই উদ্বেগের মাত্রা বেড়ে যায়। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ২০০১ সালের কথা। তখন পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে একটি গুজব রটেছিল। তখন সংবাদকর্মীসহ অনেকে বিজ্ঞানীদের শরণাপন্ন হন; তারা প্রকৃত তথ্য জানতে উন্মুখ হয়ে পড়েন।
বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের উচ্চতর গবেষণার বিষয়ে অনেকেই জানতেন। ওই সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে দেখান, সে রকম কোনো আশঙ্কা নেই।
কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সব গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোনো ক্ষতি হবে না। কাজেই গুজবে কান দেওয়া অনুচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন। তখন আমরা আশ্বস্ত হলাম। অনেকেই জানেন, আমাদের দেশের এই গুণী বিজ্ঞানী ক্যামব্রিজ ইউনিভর্সিটিতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
৩.
মহাজাগতিক রহস্যের বৈচিত্র্য এবং এসবের স্বরূপের অনুসন্ধানে জামাল নজরুল ইসলাম উন্মুখ ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন মানবিক মূল্যবোধের সংকট; এমনকি চারপাশের প্রকৃতি-পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার প্রবণতাগুলোও তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। বহুমাত্রিক জ্ঞানের অধিকারী এই বিজ্ঞানীর চিন্তার জগতের বৈশিষ্ট্য স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা বেশ কঠিন।
তার রচিত বহুল আলোচিত গ্রন্থ The Ultimate Fate of the Universe-এর একটি উদ্ধৃতি থেকেও তার মনন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা মিলতে পারে। মহাবিশ্ব ও পৃথিবীকে জামাল নজরুল ইসলাম কোন দৃষ্টিতে দেখতেন এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জ্যোতির্বিদ অধ্যাপক দীপেন ভট্টাচার্য তার এক রচনায় উল্লিখিত গ্রন্থের একটি অনুচ্ছেদের বাংলা ভাষান্তরে লিখেছেন, ‘রাতের জীবরা দিনের আলোকে যেমন আকর্ষণীয় মনে করবে না, তেমনি দূর ভবিষ্যতের অতি-শীতল মহাবিশ্বের অজানা সচেতন প্রাণীরা আমাদের উষ্ণ মহাবিশ্বকে হয়তো খুব একটা আরামদায়ক মনে করবে না। কিন্তু তবুও, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পাওয়া যাবে যাদের কল্পনাশক্তি প্রখর, তারা অতীতের দিকে, আমাদের মহাবিশ্বের দিকে ফিরে তাকাবে-দেখবে একটা পৃথিবী যা কিনা সূর্যকরোজ্জ্বল, যেখানে কয়েক কোটি বছরের শক্তি সরবরাহ নিশ্চিত, তারা ভাববে সেই পৃথিবী ছিল এক স্বপ্নের জগৎ। কিন্তু তাদের জন্য সেই স্বপ্নের পৃথিবী চলে গেছে, কোনোদিন সে আর ফিরে আসবে না। কিন্তু আজ এই স্বপ্নের পৃথিবীটা নিয়ে আমরা কী করছি? আমরা একে অপরকে অত্যাচার করছি, একে অপরকে ধ্বংসের জন্য পারমাণবিক মারণাস্ত্র তৈরি করছি, আর পৃথিবীর সম্পদকে অবাধে লুট করছি’ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ৩১ মার্চ ২০১৩)।
৪.
যেহেতু অধ্যাপক ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেছিলেন, বিজ্ঞানী ড. এম জাহিদ হাসান তাপস গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন, আশা করা যায় এ রকম মেধাবীরাই বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবেন। এ উক্তিটি আমাকে আশান্বিত হতে উদ্বুদ্ধ করে। এরপর আরও দশটি ঘটনার মতোই এ আলোচনা এবং বিজ্ঞানী ড. এম জাহিদ হাসান তাপসের নামটি স্মৃতির গভীরে চলে যায়।
এ ঘটনার দীর্ঘ সময় পর একদিন লেখক-গবেষক আনোয়ার কবির একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তার এক লেখায় বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. এম জাহিদ হাসান তাপসের একটি ঘটনা উল্লেখ করেন, যেখানে এ বিজ্ঞানীর দৃঢ় মনোভাবের কথা প্রকাশিত হয়েছে। মুহূর্তে মনে পড়ে যায় বিজ্ঞানী ড. এম জাহিদ হাসান তাপসের প্রশংসা করে অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী কী বলেছিলেন। তার সঙ্গে আমার কথোপকথনের মুহূর্তগুলো মানসপটে ভেসে ওঠে।
আমি আনোয়ার কবিরকে ফোন করে বিজ্ঞানী ড. এম জাহিদ হাসান তাপসের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র জানতে চাই। তিনি জানান, তার কাছে প্রবাসী ওই বিজ্ঞানীর ফোন নম্বর বা ইমেইল কিছুই নেই। এরপর তার কাছে ওই বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগের সম্ভাব্য সূত্র সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিছুক্ষণ পর আনোয়ার কবির আমাকে ফোন করলেন। আমি অবাক হলাম।
কারণ, স্বল্প পরিচিত কাউকে সাধারণত এভাবে সহযোগিতা করতে দেখা যায় না। প্রবাসী ওই বিজ্ঞানীর সঙ্গে সহজে যোগাযোগের সম্ভাব্য কিছু পথ দেখিয়ে দিলেন তিনি। স্বল্প পরিচিত একজনের প্রতি এমন আন্তরিকতার জন্য কবি আনোয়ার কবিরকে ধন্যবাদ জানাই। এরপর দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততার কারণে আমি ওই বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম।
৫.
সম্প্রতি যুগান্তরে প্রকাশিত ‘শ্রীপুরের জাহিদ পেলেন আর্নেস্ট অরল্যান্ডো লরেন্স অ্যাওয়ার্ড’ শিরোনামে খবরটির ওপর আমার দৃষ্টি কিছু সময়ের জন্য স্থির হয়ে থাকে।
ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. এম জাহিদ হাসান তাপস আর্নেস্ট অরল্যান্ডো অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। আরও জানতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত এ পদার্থবিজ্ঞানী আজ থেকে পাঁচ বছর আগেই তার অন্য এক আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছেন।
তার বাড়ি গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর শহরে। তিনি গাজীপুর-৩ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য অ্যাডভোকেট রহমত আলীর বড় সন্তান।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গভর্নমেন্ট প্রদত্ত যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিবিভাগ (ডিওই) মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার প্রদান করে। এ পুরস্কারের মাধ্যমে জাতীয়, অর্থনৈতিক এবং আধুনিক জ্বালানিশক্তি গবেষণার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা মার্কিন বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের সম্মানিত করা হয়। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের শক্তিবিভাগ নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্সকে সম্মান জানানোর লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে এ পুরস্কার প্রবর্তন করে।
এমন খবর শুনে অন্য দশজনের মতো আমিও গর্ব অনুভব করি। জাহিদ হাসান তাপস যে মানের গবেষণা করে চলেছেন, এর মধ্যদিয়ে আগামীতে অন্য গবেষণা কীভাবে সমৃদ্ধ হবে, তা সংশ্লিষ্ট গবেষক-শিক্ষাবিদ বা অগ্রসর নাগরিকরাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার মনে পড়ে, আনোয়ার কবিরের লেখায় উল্লিখিত কিছু তথ্য, যেখানে এই বিজ্ঞানী অল্প বয়সেই পরীক্ষায় ভালো ফলের বিষয়ে তার দৃঢ় মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন।
এই গুণী বিজ্ঞানী রাজধানীর ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলের একজন সাবেক শিক্ষার্থী। উল্লেখ্য, তিনি উচ্চ মাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে অধ্যয়ন করেছেন। ধানমন্ডি গভর্নমেন্ট বয়েজ হাইস্কুলে ভর্তির জন্য এখন কোনো ভর্তি পরীক্ষা দিতে হয় না। মাসশেষে শিক্ষার্থীর অভিভাবককে মোটা অঙ্কের অর্থও পরিশোধ করতে হয় না।
এখন যারা দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, তাদের মধ্য থেকে অনেকেই হয়তো জাহিদ হাসান তাপসের মতো এমন অ্যাওয়ার্ড পেয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবেন। আমাদের শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দেওয়া হলে তাদের সাহস বাড়বে। ‘তুমিও পারবে’-এই সাধারণ বাক্যটির মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর মনে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে।
এ বাক্যটি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-অভিভাবক-মা-বাবা অথবা কোনো আপনজন বললে শিক্ষার্থীর মননে যে পরিবর্তন আসবে, অন্য কেউ বললে তেমন প্রভাব না-ও পড়তে পারে। এখন আমাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা কি আমাদের পরিবারের অনুজ সদস্যদের অনুপ্রেরণার কথা বলব, নাকি নিরুৎসাহিত করব। তারা হতাশ হয় এমন কিছু বলা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে, একটি শিশুও আত্মসম্মান বোধের বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। কেউ কেউ পরিবারের আর্থিক সংকটসহ অন্য সমস্যার কথা চিন্তা করে এক ধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে। এটি অনুচিত।
প্রত্যেকের উচিত তার চিন্তার বিকাশে সচেষ্ট থাকা। খ্যাতিমান অনেক বিজ্ঞানী, গুণিজন অব্যাহত সংগ্রামের মাধ্যমেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। এসব তথ্য আমাদের তরুণদের বিস্তারিত জানাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বেশি সুফল পেতে হলে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাশাপাশি আমাদের শিক্ষার্থীদের সম্পদে পরিণত করতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিতে হবে।
একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে আমাদের প্রত্যেকের কী দায়িত্ব-এ বিষয়ে সচেতন থাকলে এবং নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতার পরিচয় দিলে, আমাদের তরুণরাও উদ্বুদ্ধ হবে। এর ধারাবাহিকতায় আশা করা যায়, কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যেই আমাদের স্বপ্নগুলো বাস্তবে পরিণত হবে।
লেখক : মোহাম্মদ কবীর আহমদ, সাংবাদিক