শিক্ষার্থীদের হলে বৈধ সিট পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ করেছে জুলাই বিপ্লব

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্ররা হল প্রশাসনের মাধ্যমে বৈধভাবে সিট বরাদ্দ পাচ্ছেন। অথচ এই বরাদ্দ প্রাপ্তি হাজার হাজার শিক্ষার্থীর জন্য এক সময় ছিল স্বপ্নের বিষয়।

কারণ, বছরের পর বছর ধরে সিট ব্যবস্থাপনা ছিল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোর নিয়ন্ত্রণে।
জুলাই বিপ্লব শিক্ষার্থীদের হলে বৈধভাবে সিট পাওয়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছে।


 
শিক্ষার্থীদের তাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিট বুঝে নেওয়ার এবং রাজনৈতিক দাসত্ব ও ‘গণরুম’ থেকে মুক্তি পাওয়ার আনন্দের মুহূর্তগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাগ করে নিতে দেখা যায়। ‘গণরুম,’ যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে নবীনরা সাধারণত শাসক দলের ছাত্র শাখার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হোত।

ছাত্র-জনতার নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর, হল কর্তৃপক্ষ গণরুমগুলো বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয় এবং পর্যায়ক্রমে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য সিট বরাদ্দের পাশাপাশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করা শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নোটিশ জারি করে।

বাসস’র সাথে আলাপকালে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র, রাজনৈতিক নেতা ও বহিরাগতদের দখলে থাকা কক্ষ পুনরুদ্ধার এবং বছরের পর বছর ধরে শোষিত নিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য কক্ষ বরাদ্দে হল প্রশাসনের ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করেন।

১২টি ছাত্র হলের ছাত্র এবং হাউস টিউটরগণ জানান, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে সাধারণ শিক্ষার্থীদের হলে থাকার জন্য রাজনৈতিক দাসত্ব মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কারণ, প্রশাসন সিট ব্যবস্থাপনায় কর্তৃত্ব প্রয়োগ করতে পারেনি বরং তা সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল।
 
তদুপরি, রাজনৈতিকভাবে বরাদ্দকৃত ‘গণ রুম’ বা অন্য যেকোন জনাকীর্ণ কক্ষে বেঁচে থাকার জন্য, প্রতিটি ছাত্রকে প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত নিয়মিতভাবে জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দিতে বাধ্য করা হতো। কেননা রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ লংঘিত হলে হল যেমন ছাড়তে হতো তেমনি নির্যাতনও ভোগ করতে হতো।

রাজনৈতিক কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্র হলে নিয়মিত ছাত্রদের জন্য একটি কৃত্রিম আসন সংকট তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে সকল হলের প্রায় ৫০ শতাংশ সিট মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র, বহিরাগত এবং ছাত্রলীগ নেতাদের দখলে ছিল।

হলে সিটের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায় কারণ ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রলীগের সকল নেতা, যাদের অধিকাংশই ছিল অছাত্র, হল ছেড়ে চলে যায়।

ঢাবি সিট বরাদ্দ কমিটির আহ্বায়ক ড. আয়নুল ইসলাম বাসসকে জানান, বিপ্লবের পরে হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের অধীনে প্রায় ১৫০ জন শিক্ষার্থীর আবেদনের প্রেক্ষিতে দুই ধাপে প্রত্যেক বৈধ শিক্ষার্থীর জন্য সিট বরাদ্দ করা হয়েছে।
 
আয়নুল বলেন, ‘সবার জন্য সিট বণ্টনের পর, আমাদের হলে এখনও সিট খালি রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রথমবারের মতো প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অতীতে হল কর্তৃপক্ষ সিট বরাদ্দ দিত কিন্তু ছাত্র রাজনৈতিক দখলদারিত্বের কারণে তারা সিট পেত না’।

মহসিন হলের মতোই প্রথম বর্ষ থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ছাত্রদের জন্য অন্যান্য ছাত্রাবাসে সিট বরাদ্দ ছিল।

১৫ বছরের আওয়ামী শাসনামলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ সিট ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করত এবং এর নেতাকর্মীরা স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার ছয় থেকে সাত বছর পরও কক্ষ দখলে রাখতো।

ছাত্রলীগ নেতাদের সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন ও রাজনৈতিকভাবে শোষণের ঘটনা, বিশেষ করে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলকভাবে ‘গণরুমে’ থাকার ব্যবস্থা করা ঢাবি’র ছাত্রাবাসের একটি সাধারণ দৃশ্য।

বিজয় একাত্তর হলের প্রথম বর্ষের ছাত্র রিয়াজ উল্লাহ বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের ফলে হল থেকে কৃত্রিম সিট সংকট দূর হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। আমরা হলে বৈধভাবে সিট পাওয়ার অধিকার ফিরে পেয়েছি’।

সংগঠন, কৌশল ও নেতৃত্ব বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এবং হাজী মুহাম্মদ মহসিন হলের আবাসিক ছাত্র মোহাম্মদ নাজিম বলেন, ‘রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা এত বছর নির্যাতন ও শোষণের পর অবশেষে আমরা আমাদের কাঙ্খিত সিট পেয়েছি।’
 
তবে ক্রমবর্ধমান ছাত্রী সংখ্যার বিপরীতে সিট সংখ্যা কম থাকার কারণে পাঁচটি মহিলা হলে এখনও সিট সংকট রয়ে গেছে, কারণ সিট সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সুরমি চাকমা, যিনি প্রথম বর্ষ থেকে তার জন্য শামসুন নাহার হলে সিট পেতে চেষ্টা করছেন, তিনি বলেন, ‘আমি ২০২৩ সালের আগস্টে একটি সিটের জন্য আবেদন করেছি কিন্তু আমি এখনও কোন সাড়া পাইনি। এছাড়াও, আমি প্রাপ্য বৈধ সিট চেয়ে এই মাসে আরেকটি আবেদন জমা দিয়েছি’।

ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, প্রথমবারের মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হলগুলোর সিট ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে এবং শিক্ষার্থীরা এর সুফল পাচ্ছে।

গত শিক্ষা বর্ষে শিক্ষাথীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ ছাত্রী ছিল উল্লেখ করে ড. নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, ‘এটি একটি শুভ লক্ষণ যে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের বিপুল সংখ্যক নারী শিক্ষার্থীর বিপরীতে মাত্র পাঁচটি মহিলা হল রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘মহিলা হলে সিট সংকট কমাতে একমাত্র সমাধান হল নতুন হল নির্মাণ করা, যা খুবই কঠিন। তবে, আমরা নতুন হল নির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যেই এই বিষয়ে সরকার, ইউজিসি এবং চীনা বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি।’
 
ভিসি আরও বলেন, ‘এছাড়া, আমরা আপাতত অন্তত কিছু সিট যোগ করার জন্য মহিলা হলের সক্ষমতা এবং সুবিধাগুলো পরিদর্শন করছি।’

 সিট সংক্রান্ত সমস্যা ছাড়াও, শিক্ষার্থীরা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে কারণ হাউস টিউটররা নিয়মিত হল পরিদর্শন করেন পাশাপাশি নিরাপত্তা, লন্ড্রি, স্বাস্থ্য সহায়তাসহ বিভিন্ন পরিষেবার জন্য নিযুক্ত কর্মচারীরা ছাত্রাবাসে সক্রিয় রয়েছে।

৮৭৭ জন শিক্ষার্থীর জন্য ১৯২১-২২ শিক্ষাবর্ষে তিনটি আবাসিক হল ছিল (২৯২ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি হল)। এখন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭,১৯৭, এবং তাদের থাকার জন্য ১৯টি হল রয়েছে (২,৪৮৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি হল)।

সিট ব্যবস্থাপনার উপর কর্তৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর জন্য ক্ষমতার সর্বোচ্চ উৎস ছিল কারণ শিক্ষার্থীদের হলগুলোতে থাকার জন্য তাদের আনুগত্য করতে হোত।

আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে, ১৮টি হলে কমপক্ষে ১২৮টি ‘গণ রুম’ ছিল, যেখানে প্রায় ২,৫০০ শিক্ষার্থী দুরাবস্থার মধ্যে থাকতেন।

৯ সেপ্টেম্বর, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি নোটিশ জারি করে সমস্ত হলের ‘গণ রুম’ বাতিল করে এবং সেইসাথে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করা শিক্ষার্থীদের ৩০ সেপ্টেম্বরের আগে ছাত্রাবাসগুলো খালি করতে বলে।

সূত্র: বাসস


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন দিতে এমপিও আবেদনের সময় এগোলো জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দশ দিনে আবেদন প্রায় ৬ লাখ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা - dainik shiksha বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান - dainik shiksha ধারণা বাড়াতেই পাঠ্যক্রমে তথ্য অধিকার আইন বিষয় যুক্ত: এনসিটিবি চেয়ারম্যান কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: ২১তম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ - dainik shiksha সুইডেনে স্কলারশিপে স্নাতকোত্তরের সুযোগ পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033118724822998