পৃথিবীর আধুনিক, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত দেশগুলো শিক্ষার গুরুত্ব যেভাবে বুঝতে পারে আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলোর বিধায়করা তেমনভাবে বুঝতে চান না। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক থেকে শুরু করে প্রাচীন ভারত, বিশেষ করে বাংলার রাজারাও যেভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় শিক্ষিত মানুষের ভূমিকাকে অপরিহার্য মনে করেছিলেন, এই আধুনিক সময়ে বিশ্বের সভ্য উন্নত দেশগুলো যেভাবে দেশের উন্নয়নে অর্থশক্তির ওপরে স্থান দিচ্ছে জ্ঞান শক্তিকে, সেখানে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য আমাদের রাষ্ট্রীয় বিধায়করা শিক্ষিতজনকে মর্যাদা না দিয়ে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জ্ঞানচর্চাকে পৃষ্ঠপোষকতা না দিয়ে একটি বর্বর দশায় ফেলার চেষ্টা করছেন প্রতিদিন। যে কারণে স্বাধীনতার অর্ধশতক পেরিয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু ধারার শিক্ষানীতি পেলাম না, যেখানে বিশেষজ্ঞ কমিটির বাইরে নাগরিক সমাজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্ব) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, যাও মাঝে মাঝে শিক্ষানীতির কথা শোনা যায়, কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন তেমন ঘটে না। অবস্থাদৃষ্টে প্রশ্ন জাগে যে এসব শুধু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক সরকারগুলোর রাজনৈতিক লাভালাভের হিসাব না আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ? এই অবস্থার সঙ্গে আমি সেই সব ‘কাঠমোল্লা’দের বয়ানের মিল খুঁজে পাই, যারা ইসলামের ধর্মতত্ত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করার যোগ্যতা অর্জন না করেই ওয়াজের মঞ্চ মুখরিত করেন। ইসলাম ও ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে চর্চাকারী কোনো শিক্ষিত মানুষ যদি বয়ানের অসারতা নিয়ে প্রশ্ন করেন, প্রকৃত ইসলাম ধর্মের শিক্ষাকে ভুলভাবে উপস্থাপনের কথা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং পোশাকি আলেম যদি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকে উত্তর দিতে ব্যর্থ হন তখন সহজ অস্ত্র বের করেন তাঁরা। বলেন, ‘এ জন্যই বেশি লেখাপড়া করা উচিত নয়, এরা অযথা তর্ক করে পাপী হচ্ছে।’
এগারো-বারো শতকে দাক্ষিণাত্যের সেন বংশের রাজারা বাঙালি বৌদ্ধ পাল রাজাদের দুর্বলতাকে পুঁজি করে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। তাঁরা স্পষ্টই বুঝেছিলেন এ দেশে বিপ্লবী মানসিকতার সাধারণ বাঙালি তাঁদের অন্যায় শাসন মেনে নেবে না। প্রতিবাদ করবে। তাই তাদের অবদমিত রাখতে জ্ঞানচক্ষু অন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। এরই মধ্যে বর্ণপ্রথা কঠিনভাবে প্রতিষ্ঠা করে শূদ্র অভিধায় সাধারণ বাঙালিকে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। এরপর শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হলো শূদ্রের জন্য। কারণ সেন শাসকরা বুঝেছিলেন শিক্ষার সুযোগ পেলে প্রজন্ম নিজ উজ্জ্বল সংস্কৃতির খোঁজ পেয়ে যাবে। প্রতিবাদী হবে তারা।
kalerkanthoদেশ জন্মের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকরা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মরিয়া হলো কেন? কারণ তারা বাঙালি প্রজন্মকে বাংলা ভোলাতে চেয়েছিল। ভাষা ও সাহিত্যের পথ ধরেই প্রজন্ম বাঙালির দীর্ঘদিনের উজ্জ্বল সংস্কৃতির খোঁজ পাবে। এখান থেকে তৈরি হরে স্বাজাত্যবোধ। তাই প্রতিবাদী বাঙালিকে সামনে রেখে পূর্ব পাকিস্তান শোষণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
একই কাণ্ড কি এখনো হচ্ছে না! তিন-চার দশক আগেও এ দেশে ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলের এত ছড়াছড়ি ছিল না। হঠাৎ বন্যার মতো ছড়িয়ে পড়ল কেন? ছাত্র-ছাত্রী হজম করতে পারল কি না তা না বিচার করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদ্যাচর্চায় ইংরেজি ভাষাকে আবশ্যিক করে দিল। এতে শিক্ষার্থীরা কতটা বাংলা শিখল সে প্রশ্ন করা বৃথা—তাদের যে মাতৃভাষা ভুলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে ক্রমে তা স্পষ্ট হচ্ছে। এভাবেই এই প্রজন্ম বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।
বর্তমান সময়ে যে পশ্চিমা শক্তিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার জন্য মরিয়া তারা কৌশলগত কারণে বঙ্গোপসাগরে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে চায়। তাঁবেদার সরকারগুলো হয়তো তাদের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, কিন্তু প্রতিবাদী বাঙালির কারণে সে সাহস দেখাতে পারে না। পশ্চিমা শক্তিও তা বুঝতে পারে। তাই আমরা মনে করি, তারা বাঙালি প্রজন্মকে নিজ ভাষা ও সংস্কৃতি ভোলাতে তাদের মধ্যে ইংরেজি ক্রেজ ছড়ানোর এমন মহাপরিকল্পনা করেছে। এই কথাটি বলা হয় না যে নিজ ভাষায় দক্ষ শিক্ষিত বাঙালি প্রয়োজনে ইংরেজিসহ যেকোনো ভাষা রপ্ত করে কাজ চালাতে পারে। না হলে নিজ ভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে চীন, জাপানসহ পশ্চিম ইউরোপের উন্নত দেশগুলো নিজ ভাষার বাইরে ইংরেজি ভাষাকে জায়গা না দিয়ে এতটা এগিয়ে গেল কেমন করে!
স্পষ্টতই চারটি শিক্ষা-ধারা এখন প্রচলিত। মূলধারার বাংলা মাধ্যম স্কুল এবং এর ইংরেজি ভার্সন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, আলিয়া ধারার মাদরাসা শিক্ষা এবং কওমি ধারার মাদরাসা শিক্ষা। আগে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলোর পাঠক্রম ও পরিচর্যাতে বাংলা চর্চায় ছাত্র-শিক্ষক উভয়ের সচেতনতা যতটা ছিল, এখন আর তেমনটি নেই। এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলে অধুনা বিলুপ্ত তারকাচিহ্নিত ফল করার প্রবণতা এবং বর্তমানে এ প্লাস বা স্বর্ণখচিত এ প্লাস পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা শুদ্ধ বানান ও ভাষায় বাংলা চর্চার দিকে মনোযোগ দেওয়ার সময় পাচ্ছেন না। তাই দীর্ঘ প্রতিযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মেধাবী ফল করা ছাত্র-ছাত্রীরা যখন ভুল বানান আর দুর্বল বাক্য গঠনে উত্তরপত্র লেখে তখন বোঝা যায় সংকটটি কোথায়! যখন গবেষণা প্রবন্ধ মূল্যায়ন করতে গিয়ে দেখি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ফল করে বিসিএস পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়া সরকারি কলেজের শিক্ষকের ভাষা বানানের চোখে পড়ার মতো সংকট, তখন বুঝতে পারি ভাষা ও বানান চর্চার দুর্বলতা প্রতি স্তরে ছড়িয়ে আছে।
ইংরেজি মাধ্যমে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে দ্রুতই। দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি শেখার তেমন অবকাশ নেই এদের পাঠক্রমে। সম্প্রতি সরকারি কর্তৃপক্ষ ইতিহাসচর্চার প্রতি বৈরী আচরণ করছে। তারা বোধ হয় প্রাচীন বাংলার সেন রাজাদের মতো চাচ্ছেন ইতিহাসচর্চার মধ্য দিয়ে প্রজন্ম যাতে দেশপ্রেমের চেতনা ধারণ করতে না পারে। সচেতন প্রজন্ম তৈরি না হওয়াই নিরাপদ। তাই ‘বাংলাদেশের ইতিহাস’ বলে স্কুলে আলাদা কোনো বই রাখা হয়নি। সমাজবিজ্ঞানের ভেতর যেটুকু ইতিহাস রাখা হয়েছে তাকে ইতিহাস পাঠ বলা যায় না। আর এতকাল রাজনৈতিক ইতিহাসচর্চায় আটকে থাকায় বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য জানা থেকে এমনিতেই বিচ্ছিন্ন এই প্রজন্মের অনেকে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এই ধারায় পড়া শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠক্রম বিন্যাসের দুর্বলতার কারণে যতটা ভালো ইংরেজি বলতে পারছে ততটা ভালো দখল দেখাতে পারছে না ইংরেজি ভাষা ও গ্রামারে। বিশেষ করে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন এদের মধ্যে দেশাত্মবোধ তৈরি হওয়াটা খুব কঠিন।
আলিয়া ধারার মাদরাসা শিক্ষা বাংলা মাধ্যম মূলধারার সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কিত। তাই বাংলা মাধ্যম শিক্ষার অনুরূপ সংকট এই অঞ্চলেও রয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় সংকটে আছে কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। এ দেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের দুই-তৃতীয়াংশ কওমি মাদরাসায় পড়ে। আরবি, ফারসি ও উর্দু কওমি মাদরাসার শিক্ষা মাধ্যম। বাংলা ও ইংরেজির সঙ্গে এদের সম্পর্ক কম। আজকাল যদিও কারিকুলামে কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে, তবে তা থেকে কাম্য সাফল্য অর্জিত হওয়া কঠিন। দেশ, জাতি ও জাতীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে এ অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের অনেকের ধারণাই খুব অস্পষ্ট। এরা নিজেদের এবং দেশ ও সমাজের বোঝায় পরিণত হচ্ছে। আমাদের পূর্বসূরিরা আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করে আত্মপরিচয়কে সমুন্নত রাখতে পেরেছিল। কিন্তু চৈতন্য-বিচ্ছিন্ন আমরা নানাভাবে একে লালন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। এক ধরনের উগ্র আধুনিকতা ও অপূর্ণ বৈশ্বিক ভাবনা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজার অর্থনীতির বিকৃত ধারণা থেকে আমরা বাঙালি সংস্কৃতির বিকলাঙ্গ অবয়ব উপস্থাপন করছি। আমাদের চারপাশে অর্থবিত্তে আভিজাত্য খোঁজা অনেক পরিবারকেই পাওয়া যাবে যাদের বাংলা ভালো বলতে না পারা বা লিখতে না পারার মধ্যে এক ধরনের অহমিকার ছোঁয়া থাকে।
বাংলা একাডেমি একটি প্রমিত বাংলা বানানরীতি প্রণয়ন করেছে। আবার জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড তাদের বই লেখার জন্য একটি বানানরীতি ধরিয়ে দেয়। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে লিখতে গিয়ে আরেক বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। আমার প্রমিত বানানরীতির কোনো কোনো বানান সংশোধন করা হয়। জানতে চাইলে বলা হয়, এটি এই পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালা।
আমরা প্রত্যাশা রাখি, আমাদের রাজনৈতিক সরকারগুলো এই উপলব্ধিতে আসুন যে প্রকৃত শিক্ষাবিদদের পরিচর্যায় শিক্ষাঙ্গন নতুনভাবে ঘুরে দাঁড়াক। শিক্ষাসংকট তৈরি করা রাজনৈতিক অপচ্ছায়া থেকে মুক্তি পাক দেশ ও জাতি। দেশ বিধায়কদের মনে এই সত্যটি জায়গা করে নিক যে শিক্ষা উন্নয়নকে পৃষ্ঠপোষকতা না দিলে এবং শিক্ষাকে সর্বোচ্চ সম্মান না দিলে রাষ্ট্রে কোনো উন্নয়নই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারবে না।
লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ,অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়