শিক্ষায় করোনার ক্ষতি পোষানোই বড় চ্যালেঞ্জ

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক: |

কিংবদন্তির শিক্ষক নেতা মাজহারুল হান্নান ৩৮ বছর শিক্ষকতা করে অবসরজীবন কাটাচ্ছেন। শিক্ষকতার এই দীর্ঘ সময়ে এখনকার মতো এত লম্বা সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে দেখেননি তিনি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর এবারই অস্বাভাবিক ছেদ পড়ল স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি, তা সহজে পূরণ হবে না বলে মনে করছেন তিনি।

করোনা মহামারির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ১০ মাস ধরে। এই সময়ে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত দেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ও শিক্ষাপঞ্জি ওলটপালট হয়ে গেছে। সংসদ টিভি, অনলাইন, রেডিও এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দূরশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও বাস্তবে ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এই ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেনি। বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযানের এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। দূরশিক্ষণ বা অনলাইনে পাঠদানের ব্যবস্থাটি গ্রাম-শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্যও বাড়িয়েছে। একজন শিক্ষার্থীর যে শ্রেণিতে যা শেখার কথা, তা শিখতে পারছে না। পরীক্ষাগুলো না হওয়ায় মূল্যায়ন যথাযথ হচ্ছে না। ফলে বড় ঘাটতি নিয়েই ওপরের শ্রেণিতে উঠছে শিক্ষার্থীরা। এদের ক্ষতি পোষানোই সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এই সংকটের নানামুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে শিক্ষা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ওপর। এতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম বাড়বে। দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকায় অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অসংখ্য শিক্ষার্থী পড়াশোনার স্বাভাবিক ছন্দ হারাবে। দীর্ঘদিন ঘরবন্দী থাকায় অনেক শিশুর মানসিক বিকাশও প্রভাবিত হবে। আবার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীরা আর্থিকভাবে সংকটে পড়ছেন। অসংখ্য কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে ও যাচ্ছে। সব মিলিয়ে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুরো শিক্ষাব্যবস্থার ওপর।

শিক্ষার এই সংকট বৈশ্বিক। এমন পরিস্থিতিতে আজ ২৪ জানুয়ারি পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিক্ষা দিবস। ইউনেসকোর উদ্যোগে এবার তৃতীয়বারের মতো দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘কোভিড-১৯ প্রজন্মের জন্য পুনরুদ্ধার ও পুনরুজ্জীবিত শিক্ষা’।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ বলেন, করোনার আগেও সব শিক্ষার্থী সবকিছু শিখে ওপরের শ্রেণিতে উঠতে পারত না। কিন্তু করোনার কারণে শেখার এই সমস্যা মারাত্মক হয়েছে। যেসব শিক্ষার্থী তুলনামূলক বেশি মেধাবী এবং বাড়িতে বাড়তি সুবিধা আছে, তারা কিছুটা এগিয়ে থাকবে। বাকি শিক্ষার্থীদের সংকটটা বেশি হবে। তাই বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে এ ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য স্কুল ও উপজেলাভিত্তিক শিক্ষা উদ্ধার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।

লম্বা বন্ধের প্রভাব পড়ালেখার ওপর


শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে সারা দেশে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে পড়ে প্রায় পৌনে দুই কোটি ছাত্রছাত্রী। মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির কিছু বেশি। আর কলেজে মোট শিক্ষার্থী প্রায় অর্ধকোটি। বাকি শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা, মাদ্রাসা, ইংরেজি মাধ্যমসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ে।

করোনার কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি চলছে। ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটির ঘোষণা আছে। সরকার গত ২৯ মার্চ থেকে মাধ্যমিকের এবং ৭ এপ্রিল থেকে প্রাথমিকের রেকর্ড করা ক্লাস সংসদ টেলিভিশনে প্রচার করছে। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, মন্দের ভালো হিসেবে এই পদ্ধতি চালু হলেও এটি কার্যকর ফল দিচ্ছে, তা বলা যাবে না। এই পদ্ধতিতে কেবল ক্লাস অনুসরণ করা যায়, শিক্ষার্থীরা সরাসরি অংশ নিতে পারে না। ফলে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই আস্তে আস্তে এই প্রক্রিয়া থেকে সরে গেছে।

১৯ জানুয়ারি শিক্ষা নিয়ে ‘এডুকেশন ওয়াচ’ নামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে গণসাক্ষরতা অভিযান। তাতে দেখা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এই দূরশিক্ষণ কার্যক্রমে অংশ নেয়নি। নিয়েছে মাত্র ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ। এর আগে গত বছর ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের ৫৬ শতাংশ টেলিভিশনের ক্লাসে অংশ নেয়নি।

বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বড় পদ্ধতি হলো পরীক্ষা। কিন্তু করোনার বাস্তবতায় সেটিও বাতিল করতে হয়েছে। প্রাথমিকে বছরে তিনটি পরীক্ষা হয়। প্রথম সাময়িকী ও দ্বিতীয় সাময়িকী এবং বার্ষিক পরীক্ষা। এ ছাড়া পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য জাতীয়ভাবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া হয়। কিন্তু বিদায়ী বছরে এসব কোনো পরীক্ষাই হয়নি।

সরকার ঘোষণা দিয়েছে, পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা ওপরের শ্রেণিতে উঠবে। তবে প্রাথমিকে শিক্ষকেরা নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করবেন। কিন্তু একাধিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো নির্দেশনা না থাকায় মূল্যায়নের কাজটি যেনতেনভাবে করা হয়েছে। মাধ্যমিকে পরীক্ষা হয় দুটি। একটি অর্ধবার্ষিক এবং আরেকটি বার্ষিক পরীক্ষা। সেগুলোও নেওয়া যায়নি। এমনকি বিদায়ী বছরের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষাও বাতিল করতে হয়েছে। গত ডিসেম্বরে এসব শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে হয়েছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী এরাও ওপরের শ্রেণিতে উঠে যাবে।

দেশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম দেখভাল করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। সংস্থাটির মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, তাঁরা সারা দেশের ১১৫টি উপজেলা থেকে শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছেন, প্রায় ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিয়েছে। আশা করা হচ্ছে, অন্তত এই ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে না।
এখন সারা দেশ থেকে অ্যাসাইনমেন্টের নমুনা সংগ্রহ করে জাতীয়ভাবে একটি বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এর ভিত্তিতে নতুন বছরের জন্য করণীয় ঠিক করে কাজ শুরু করা হবে বলে জানান মাউশির মহাপরিচালক।

করোনা শুরুর আগেই ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু করোনার কারণে বিলম্বে ফল প্রকাশ করায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা দেরিতে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে কোনো ক্লাস তারা এখনো পায়নি। অনেক কলেজ অনলাইনে ক্লাস করাচ্ছে। কিন্তু বিদায়ী বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এখন এসব শিক্ষার্থীর জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার গড় ফলের ভিত্তিতে ফল মূল্যায়নের কাজটি চলছে। একই কারণে আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাও প্রায় চার মাস পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে আগামী জুনে এসএসসি এবং জুলাই-আগস্টে এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা। কিন্তু নির্ধারিত ক্লাস করতে পারেনি শিক্ষার্থীরা। এখন পাঠ্যসূচি কাটছাঁট করে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।

এডুকেশন ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর মত হলো, যেসব বিষয় পড়ানো হয়নি, ক্লাস শুরু হলে সেগুলো যেন আগে পড়ানো হয়।

উচ্চশিক্ষা স্তর, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় এক বছরের সেশনজট তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো (অনার্স ও মাস্টার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা) নিচ্ছে।

পড়াশোনার এই সংকটের বিষয়ে সম্প্রতি এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, অনলাইন ও টেলিভিশন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শতভাগ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছানো যায়নি। ফলে কিছুটা ঘাটতি নিয়েই ওপরের শ্রেণিতে যাবে তারা। এই ঘাটতি কোথায় কোথায় হচ্ছে, সেটা জানার জন্যই শিক্ষার্থীদের অ্যাসাইনমেন্ট নেওয়া হয়েছে। এগুলো দেখে ২০২১ সালে শিক্ষার পাঠ্যসূচিসহ পুরো পরিকল্পনা করা হবে। হয়তো একটি শিক্ষাবর্ষে এই ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব না-ও হতে পারে। একাধিক শিক্ষাবর্ষে সেটি পূরণের চেষ্টা করা হবে।

করোনার ধাক্কায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা আর্থিকভাবেও সংকটে পড়েছেন। গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে শিক্ষার্থীদের ৭৩ শতাংশ পরিবার মৌলিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম থাকলেও গত বছর মহামারির কারণে তা ২৯ শতাংশ ৪৬ শতাংশে নেমে গেছে। শিক্ষকদের ৯৩ শতাংশ পরিবার ২০১৯ সালে মৌলিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম থাকলেও বিদায়ী বছরে সেটি কমে হয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৫ শতাংশ। করোনার অভিঘাতে শিক্ষাখাতের এসব ক্ষতি পোষাতে নানামুখী বিকল্প ব্যবস্থা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে এগোনোর পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষাবিদেরা।

সূত্র: প্রথম আলো 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032119750976562