চীন-ভারতের বৈরিতা এখন আর শুধু সীমান্তের লাইন অব কন্ট্রোলে আটকে নেই। বছর তিনেক আগে লাদাখ সীমান্তে শুরু হওয়া উত্তেজনার জের এখন ছড়িয়ে পড়েছে আরো অনেক ক্ষেত্রেই। কিছুদিন আগেও চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা গবেষণা ও একাডেমিক কাজে আমন্ত্রণ পেয়েছেন ভারতীয় গবেষক-বিশেষজ্ঞরা। চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছেন ভারতীয় শিক্ষার্থীরাও।
কিন্তু বর্তমানে চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভারতীয় শিক্ষার্থী ও একাডেমিকদের আমন্ত্রণ জানানো কমে এসেছে। এর মধ্যে গবেষক ও শিক্ষাবিদ বিনিময়ের কাজটি নানা সময়ে দুই দেশের ট্র্যাক-২ পর্যায়ের সংলাপ (ব্যাকচ্যানেল কূটনীতি হিসেবেও পরিচিত। এক্ষেত্রে বেসরকারি ও ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক সংলাপ বা কার্যক্রম অনেক সময় আনুষ্ঠানিক কূটনীতিকদের কার্যক্রমে সহায়ক ভূমিকা রাখে) হিসেবেও কাজ করেছে। বর্তমানে শিক্ষা খাতে দুই দেশের বিনিময় কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ট্র্যাক-২ কার্যক্রমও পুরোপুরি থমকে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় ভারতীয় শিক্ষাবিদ ও শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বড় গন্তব্য হয়ে উঠেছে তাইওয়ান।
চীনের শিক্ষার্থীরাও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের সংঘাতের আগে ভারতে ডক্টরাল ডিগ্রিসহ বিভিন্ন গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তি হয়েছেন। যেমন চীনের সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক লি লি তার পিএইচডি সম্পন্ন করেছিলেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি (জেএনইউ) থেকে। চীনের বর্তমান সময়ের অনেক পণ্ডিত ব্যক্তিই জেএনইউর সাবেক শিক্ষার্থী।
সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ বিভাগের উদ্দেশ্যগুলোকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে ‘ভারতের কৌশলগত সংস্কৃতি, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্র, চীনের দক্ষিণ এশিয়া নীতি, চীন-ভারত সম্পর্ক এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বাস্তবায়ন’কে অধ্যয়ন করা।
গত তিন বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টির কোনো আলোচনা বা সংলাপে ভারতীয়দের রাখা হয়নি। চীনে এখন সাউথ এশিয়ান স্টাডিজবিষয়ক যাবতীয় কার্যক্রম বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে সীমিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তানকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
চীন ও ভারতের মধ্যে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ মাত্রায় ট্র্যাক-২ সংলাপ হয়েছিল ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে। চীনের সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ও কর্ণাটকের মানিপাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব চায়না স্টাডিজ এবং নয়াদিল্লির ইনস্টিটিউট ফর চাইনিজ স্টাডিজের মধ্যে হরিয়ানার মানেসারে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। চীনের তৎকালীন স্টেট কাউন্সিলর দাই বিংগুয়ো ও ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশংকর মেননসহ দুই দেশের ৪০-এর বেশিসংখ্যক রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ এ সংলাপে যুক্ত হন। ওই সময় দুই দেশের প্রতিনিধিদের আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও অর্থনীতি। সৌহার্দপূর্ণ সে আলোচনায় সীমান্ত বিরোধ, প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তাসংক্রান্ত ইস্যুগুলো খুব কমই প্রাধান্য পেয়েছে। সে সময় বিরোধকে পাশ কাটিয়ে দুই পক্ষই ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়ানোয় আন্তরিকতা দেখিয়েছে বেশি।
এরপর এ ধরনের সংলাপের উদ্যোগ নেয়া হলেও ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের জুনে গালওয়ান সংঘর্ষের কারণে আয়োজন ও আলোচনা—দুটোরই গভীরতা ছিল কম। ২০২০ ও ২০২১ সালে এ সংলাপ হয়েছে ভার্চুয়ালি। এর মধ্যে চতুর্থ দফার সংলাপ চলাকালে ভারতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত সুন ওয়েইদং এক বক্তব্যে বলেন, ‘সম্পর্ক নষ্ট করতে একটি পক্ষই
যথেষ্ট। কিন্তু ভালো সম্পর্ক তৈরি করতে দুই পক্ষকেই সক্রিয় হতে হয়। চীন-ভারতের সম্পর্ক হওয়া উচিত দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে, যাতে দুই পক্ষই একে অন্যের চিন্তাভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে লাভবান হতে পারে। এটি কোনো একমুখী সড়ক নয়, যেখানে এক পক্ষ কেবল অনুরোধ ও শর্ত জানাবে আর অন্য পক্ষ শুধুই প্রতিক্রিয়া দিতে বাধ্য হবে।’
সামনের দিনগুলোয়ও চীনের মূল ভূখণ্ডে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা করতে যাওয়াটা অনেক মুশকিল হতে পারে বলে ধারণা করছেন ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। এর কারণ সম্পর্কে তাদের ভাষ্য হলো আগামী এক দশকেও দুই দেশের মধ্যকার ভূরাজনৈতিক বৈরিতা প্রশমনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে আমন্ত্রণ কমে আসায় ভারতীয় শিক্ষার্থীরা এখন মনোযোগ বাড়িয়েছেন তাইওয়ানের দিকে। ভারত ও তাইওয়ানের মধ্যে এ ধরনের সংযোগ একেবারেই নতুন। ১৯৫০ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনকে নয়াদিল্লি স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে ভারত ও তাইওয়ানের মধ্যে সংযোগটি অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে আসে। কিন্তু বেইজিং ও নয়াদিল্লির মধ্যকার সম্পর্কে ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের চীনসংক্রান্ত পড়াশোনার জন্য তাইপেই এখন সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা।