দেশের উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। তাই সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য শিক্ষার পেছনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হয়। এটা সময়ের দাবি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন একটি পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়িত হচ্ছে। পুরোপুরি বাস্তবায়নে আরো সময় প্রয়োজন। প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও দক্ষ শিক্ষক। না হলে শিক্ষা পিছিয়ে পড়বে। শিক্ষা পিছিয়ে পড়লে দেশও পিছিয়ে পড়বে। যে উন্নয়ন দৃশ্যমান নয় কিন্তু স্থায়ী সেটি হলো শিক্ষা। তাই এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া চলবে না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে ব্যয়ের জন্য ইউনেসকোর পক্ষ থেকে পরামর্শ থাকলেও সর্বশেষ বাজেটে এ বরাদ্দ হয় জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষায় জিডিপির ৫ শতাংশ বা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ বরাদ্দ করার বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের আশ্বাস থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি। আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে তাই শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি নতুন করে উচ্চারিত হচ্ছে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ, কঙ্গো ও উগান্ডা ২ দশমিক ২ শতাংশ, চাদ ২ দশমিক ৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ২ দশমিক ৬ শতাংশ, রুয়ান্ডা ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, সেনেগাল ও ইথিওপিয়া ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং সিয়েরা লিওন ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ব্যয় করে শিক্ষা খাতে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশের গড় শিক্ষা ব্যয় আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে কম। ভুটান ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জিডিপির ৭ শতাংশ, ভারত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, পাকিস্তান ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ২ দশমিক ৪ শতাংশ, মালদ্বীপ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, নেপাল ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ৪ দশমিক ২ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১ দশমিক ৯ শতাংশ এবং আফগানিস্তান ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে ২ দশমিক ৯ শতাংশ ব্যয় করেছে শিক্ষা খাতে। বাংলাদেশেও শিক্ষাখাতে অধিক বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।
আমাদের দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার বিভিন্ন স্তরে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কারিগরি শিক্ষা এগিয়ে নিতে হবে। কারণ, দেশের বেকার সমস্যা সমাধানে কারিগরি শিক্ষা প্রধান সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সেইসঙ্গে সাধারণ শিক্ষার গুণগত মানের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং এর সঙ্গেই গবেষণায় ব্যাপক মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। দেশে গবেষণার দিক অত্যন্ত দুর্বল। শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ডিজিটালাইজেশনের লক্ষ্যে আমাদের অগ্রসর হতে হবে।
আমরা দেখেছি, ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিলো ২৬ হাজার ৩১৪ কোটি টাকা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিলো ৩৬ হাজার ৪৮৬ কোটি টাকা এবং কারিগরি ও মাদরাসা খাতে বরাদ্দ ছিলো মাত্র ৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। আগামী অর্থবছরে এ খাতে আরো বেশি বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন। কারণ, টেকসই শিক্ষা অর্জন করতে হলে শিক্ষার মতো মহাগুরুত্বপূর্ণ খাতকে সর্বাগ্রে এগিয়ে নিতে হবে। শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, শিক্ষার গুণগত উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ করা, শিক্ষা উপকরণ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
যতোদিন শিক্ষাকে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানের করা না যাবে ততোদিন দেশ কাঙ্ক্ষিত সাফল্য পাবে না। ফলে এ খাতে বেশি গুরুত্ব দেয়া আবশ্যক। পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকেই উন্নত করতে হবে। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাখাতে যে চাহিদাগুলো রয়েছে সেগুলো পূরণের উদ্যোগ নিতে হবে।
আমাদের দেশে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি দীর্ঘদিনের। তা ছাড়া, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতার দাবিও রয়েছে। সুতরাং এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষকদের বেতনও বাড়ানো দরকার। সবচেয়ে ভালো হয় শিক্ষকদের জন্য একটি পৃথক বেতন কাঠামো করা গেলে। সেটি সম্ভব না হলেও পাশের দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি বেতন কাঠামো বাস্তবায়ন দরকার। কারণ, শিক্ষক যদি পেটের চিন্তায় থাকে তাহলে তাকে দিয়ে শিক্ষার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন অসম্ভব। আর শিক্ষা বাস্তবায়ন যদি অসম্পূর্ণ থেকে যায় সেটি জাতির জন্য সুখকর হবে না।
শিক্ষাই সবচেয়ে বড় সম্পদ। এই একটা খাত আরো অনেক খাতকে শক্তিশালী করতে পারে। আমরাও আশা করি এই খাতটি আরো বেশি বরাদ্দ পাক। শিক্ষা ও প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ দেশকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে শিক্ষাখাতে আরো বেশি বরাদ্দ প্রত্যাশা করি। বাজেটের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি ইতোমধ্যে তুলেছেন শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। আমাদের সবার প্রত্যাশা এ বছর এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের যে হাওয়া লেগেছে তা এগিয়ে যাবে সাবলীলভাবে।
লেখক: শিক্ষক