শিক্ষায় সংখ্যাগত অর্জন অনেক, নেই গুণগত মান : আজাদ চৌধুরী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

উচ্চশিক্ষায় বাংলাদেশের বিশাল বিস্তৃতি হয়েছে। সংখ্যার বিচারে আমরা অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছি। দেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় ৪৪ লাখ শিক্ষার্থী আছে। কোনো দেশে এত জনসংখ্যাও নেই। সেই বিচারে শিক্ষায় সংখ্যাগত অর্জন অনেক। কিন্তু গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষা, শিক্ষকের গুণ, ছাত্রদের রাজনীতি ও আদর্শের দিকে তাকালে মনে হতে পারে আমাদের সেই আকাক্সক্ষা এখনো পূরণ হয়নি। মূল্যবোধের উন্নয়ন তো হয়ইনি, বরং অবনতি হয়েছে। বিশেষ করে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং গবেষণায় খুব একটা অর্জন আমাদের নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষকতায় আসেন তাদের একটা মান অর্জন করতে হয়। হতে পারে কেউ অন্য চাকরি না পেয়ে স্কুল-কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকতায় আসেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে সেটা হয় না।

শিক্ষকতাকে আদর্শ হিসেবে নিয়ে এবং পছন্দ ও পরিকল্পনা করেই একজনকে এই পেশায় আসতে হয়। অন্য চাকরি না পেয়ে এখানে আসার প্রসঙ্গ পুরোপুরি সত্য নয়। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় ও তদবির হয়তো কাজ করে। তবে তাও প্রকট নয়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে বলা যায়, কিছু কিছু ঘটনা থাকতে পারে, তবে তা ‘র‌্যানডম’ (সাধারণ চিত্র) নয়। আর নিয়োগের জন্য তদবির করা হলেও এখানে ব্যবস্থাটা এমন যে, প্রার্থীকে ন্যূনতম একাডেমিক রেজাল্ট নিয়েই আবেদন করতে হয়। একটা ‘স্ট্যান্ডার্ড’র (মান) নিচে নামা সম্ভব হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলে শয্যা সংখ্যায় ঘাটতি আছে। ছাত্রছাত্রীদের হলে এক বা দুই সিটবিশিষ্ট কক্ষ এখন আর তেমন মুখ্য বিষয় নয়। সেখানে চারজনের সিটে আটজন থাকে। আছে গণরুম। আসলে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ক্ষেত্রে আমাদের অনেক কিছু করার আছে। ‘গণরুম’ শব্দটা আমাদের জন্য একটা লজ্জার বিষয়। সেখানে বসবাস নিয়ে নানান কথা আছে।

একটা কথা বলে রাখা ভালো। শিক্ষার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে। এর একটা হচ্ছে আদর্শের জন্য লেখাপড়া। সুকুমারবৃত্তির চর্চা, মানবিকতার বিকাশ ও মূল্যবোধ লালন একটা উদ্দেশ্য। আরেকটা হচ্ছে, প্রায়োগিক দিক। এর মধ্যে আসে চাকরি, নিয়োগ ও কর্ম ইত্যাদি। এই দুটির সমন্বয় করেই শিক্ষা অগ্রসর হয়। কিন্তু বর্তমানে মনে হচ্ছে, মানবিক মূল্যবোধ আর সামাজিক নৈতিক আদর্শের দিকটি অনেকটা পিছিয়ে গেছে। তবে এগুলো কীভাবে জাতীয় জীবনে ফের কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় পুনঃস্থাপন করা যায় সেটা ভাবতে হবে। আদর্শ আর নৈতিকতার প্রসঙ্গে কেবল শিক্ষাঙ্গনের কথা বলব কেন, গোটা সমাজেই তো এর একটা ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, সংখ্যাগত অর্জন অনেক হয়েছে। গুণ, মান ও আদর্শের দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। মূল্যবোধ ও প্রায়োগিক শিক্ষার জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। এ ক্ষেত্রে সরকার সহায়কের ভূমিকায় থাকতে পারে। কিন্তু মূল কাজটি শিক্ষকদেরই করতে হবে। এসব করা না হলে বেকারের সংখ্যা যেমন বাড়বে, তেমনি সমাজে অস্থিরতা তৈরি হবে। পাশাপাশি সমাজে অনেক রকম ঘটনা ঘটবে। যা শিক্ষকদের কাছে প্রত্যাশিত নয়। যেহেতু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিসহ অনেক কিছু হয়েছে, এখন নৈতিক ও মূল্যবোধের উন্নয়নের জন্য শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতেই হবে। যে আদর্শ নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তা যদি সব ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি, তাহলে শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব। এই আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ গড়ে তুললে সংকট তৈরি হবে না।

বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সমস্যা বিরাজমান আছে তা দূর করতে শিক্ষায় যথাযথ বিনিয়োগ করতে হবে উল্লেখ করে ঢাবির সাবেক এ উপাচার্য বলেন, জাতীয় বাজেট আগের তুলনায় ৫ থেকে ১০ গুণ বেড়েছে। এখন ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। টাকার অঙ্কে হয়তো শিক্ষা খাতেও কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে হারে বাজেট বেড়েছে সেই বিবেচনায় আনুপাতিক হারে শিক্ষায় টাকার অঙ্কের বরাদ্দ বেড়েছে কিনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জিডিপির ৪ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দের কথা বলেছেন অর্ধশত বছর আগে। এখনকার বাস্তবতায় আরও বেশি বরাদ্দ প্রয়োজন। সেটা তো হয়নি, বরং এখনো ২ থেকে ২ দশমিক ২ ভাগের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি। আবার যেটা শিক্ষায় বরাদ্দ হয়, তার মধ্যে অন্যান্য ভাগও যুক্ত হয়। যদি জিডিপির ৪ শতাংশ বরাদ্দ করা হতো তাহলে আবাসিক হল কেন, গবেষণাসহ নানান খাতে অনেক বরাদ্দ দেওয়া যেত। ছাত্র-শিক্ষকের সমস্যা দূর করার পাশাপাশি চাকরির সংস্থানও হতো। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা দূর করতে হলে বাজেটে সেভাবে বরাদ্দ রাখতে হবে।

তিনি বলেন, আমার মনে হয়, শিক্ষা এখনো সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার নয়। গার্মেন্ট, কর্মসংস্থান, অদক্ষ শ্রমশক্তিসহ যেসব দিকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে, সেটাও দরকার আছে। কিন্তু শিক্ষাকেও গুরুত্ব দিতে হবে। কেননা ২০৪১ সালের একটা রূপকল্প আমরা নির্ধারণ করেছি। জাতিসংঘ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ঠিক করে দিয়েছে। আমরা এসব অর্জন করতে চাইলে ‘ইনক্লুসিভ’ (সমন্বিত) উন্নয়ন করতে হবে। আর সেজন্য শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ভবিষ্যৎ জনশক্তিকে প্রস্তুত করতে হলে তাদের কারিগরি জ্ঞান দিতে হবে। পাশাপাশি নৈতিক, আদর্শ ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন করে তুলতে হবে। শিক্ষায় যথাযথ ও পর্যাপ্ত অর্থায়ন করে শিক্ষাক্রম ও আনুষঙ্গিক দিক উন্নয়ন করতে হবে। তাহলেই জাতি এগোবে বলে মনে করি।

সূত্র : দৈনিক যুগান্তর।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025970935821533