শিক্ষিত বেকারত্ব দূরীকরণে কারিগরি শিক্ষা

অলোক আচার্য, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

উচ্চশিক্ষা যখন চাকরির নিশ্চয়তা দিতে ব্যর্থ হয় তখন সার্বিকভাবে সেই শিক্ষার্থীর ভেতর হতাশা বিরাজ করে। অথচ উচ্চ শিক্ষিত হয়ে তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো চাকরি পাওয়ার ইচ্ছা থাকাই স্বাভাবিক।  বৈশ্বিক পরিস্থিতি এই সংকটকে আরো তীব্র করে তুলেছে। যে হারে বা যে সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতি বছর লেখাপড়া শেষ করে কাজের বাজারে যুক্ত হয় তার অল্পসংখ্যকই চাকরির বাজারে টিকতে পারছে। উচ্চশিক্ষা চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।

এক সময় যেমন ভাবা হতো যে, লেখাপড়া শেষ করলেই অন্ততপক্ষে একটা চাকরি করে পরিবারের হাল ধরবে, আজ আর সেই ধারণা নেই। লেখাপড়া শেষ করাটাই বরং অনেক বেশি সহজ। বিপরীতে চাকরি পাওয়াটা সোনার হরিণের থেকেও বেশি কিছু। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস), বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোসহ (বিবিএস) বিভিন্ন সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চিত্র। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষিত তরুণরা বেকার থাকায় রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তি সম্পদের অপচয় হচ্ছে। ফলে দক্ষতা বৃদ্ধি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 

শিক্ষার মান বাড়িয়ে বাস্তব কাজের সঙ্গে সংযুক্ত করার এখনই সময়। উচ্চশিক্ষা এখন আর ভালো বা একটু কম ভালো চাকরির মানদণ্ড নয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে এর হার ছিলো ১৯ দশমিক ২ শতাংশ, সেটি বেড়ে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে হয়েছে ১২ শতাংশ। এই ৫ বছরে স্নাতক পাস করা বেকারের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের হিসাবে এ সংখ্যা ছিলো ৪ লাখ, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লাখে।

কর্মে নিয়োজিত রয়েছেন ৬ কোটি ৮ লাখ। বহু বছর ধরেই আমাদের কর্মসংস্থানের বিষয়টি শুধু চাকরিমুখী হয়েছে। অর্থাৎ লেখাপড়া শেষে চাকরিই শেষ কথা। একসময় হয়তো উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীর সংখ্যা কম ছিলো। যদিও দেশে গত ৩ মাসে বেকারের সংখ্যা ৯০ হাজার কমেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) জানিয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, এ অর্থবছরের আগের প্রান্তিকের তুলনায় এপ্রিল-জুনে বেকারের সংখ্যা কমেছে ৩ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি-মার্চের হিসাবে বাংলাদেশে বেকার ছিলো ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এপ্রিল-জুনের হিসাবে বেকার ২৫ লাখ। আগের বছরের এপ্রিল-জুনে বেকার ছিলো ২৫ লাখ ৬০ হাজার। এ বছরের এপ্রিল-জুনের হিসাবে বেকার পুরুষের সংখ্যা ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমে ১৬ লাখ ৭০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। একই সময়ে বেকার নারীর সংখ্যা ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ কমে ৮ লাখ ৩০ হাজার হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে ৫৭টি (২০২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৫০টি) সরকারি এবং ১০৮টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। অর্থাৎ এই অর্ধশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষা সম্পন্ন করে বের হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমান পরীক্ষা শেষে দেশে নতুন করে প্রতি বছর যুক্ত হচ্ছে ৫ লাখ শিক্ষিত বেকার। ১০ বছরের মাধ্যমিক ও দুই বছরের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে লেখাপড়া করেও বলতে গেলে তারা অনুৎপাদনশীল। দেশের অর্থনীতিতে কোনো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারছে না। কিন্তু তার তুলনায় চাকরির বাজার সৃষ্টি হচ্ছে খুব কম। ক্ষেত্রবিশেষে অনেকের জন্যই চাকরির বাজার কমছে।

কারণ কারিগরি দক্ষতার অভাব। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী কারিগরি শিক্ষায় দেশের মোট শিক্ষার্থীর মাত্র ১০ থেকে ১২ শতাংশ লেখাপড়া করে। তা ৩০ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা থাকলেও কারিগরি শিক্ষায় অনীহা রয়েছে। লন্ডনের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) তথ্যমতে, বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারী তরুণ-তরুণীর মধ্যে ৪৭ জন বেকার। ভারত ও পাকিস্তানে প্রতি ১০ জন শিক্ষিত তরুণের তিনজন বেকার। এখন যত সংখ্যক ছেলেমেয়ে উচ্চশিক্ষা নিয়ে চাকরির বাজারে পা রাখছেন তত সংখ্যক চাকরি খালি নেই। আবার এর মধ্যেও আছে বিভাজন। যার টাকা, যোগাযোগ আছে তার চাকরি হচ্ছে, মেধাবীরা বাদ পড়ছেন। এসব নানা কারণে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর সঙ্গে এসব বেকারের চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা বিরাজ করছে। সেই উচ্চশিক্ষিত যুবক যুবতীর চাপ কেমন তা বোঝা যায় এক একটি সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে। প্রতি বছর আবেদনকারীর সংখ্যা ব্যাপক বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেখানে সহজেই অনুমেয় যে, একটি চাকরির জন্য কত সংখ্যক বেকার ছেলেমেয়ে অপেক্ষা করছেন।  

প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনে উচ্চশিক্ষা লাভের স্বপ্ন থাকে। এই স্বপ্ন সবার ক্ষেত্রে পূরণ হয় না। কেউ কেউ মাঝপথেই ঝরে পড়েন। বর্তমানে সরকারের নানামুখী কল্যাণমূলক উদ্যোগের কারণে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। আগে এসএসসি বা এইচএসসির পরে বা তারও আগে অনেকেই কোনো জীবিকা খুঁজে নিতেন। বিশেষ করে অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের ঝরে পড়ার হার বেশি ছিলো। কারণ উচ্চশিক্ষায় লেখাপড়ার খরচ চালানোর মতো সামর্থ্য অনেকেরই ছিলো না। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষা ছিল আরো প্রতিবন্ধক। যদি কেউ সাধারণ শিক্ষার দিকে না গিয়ে কারিগরি শিক্ষার দিকে যান তাহলে কোনো বিষয়ে ডিপ্লোমা এবং পরে বিএসসি করছেন। এখন কারিগরি শিক্ষাকেই বেশি উৎসাহিত করা হচ্ছে। তার লক্ষ্যও বেকার সমস্যা দূরীকরণ।

চাকরি না পেলেও তার কারিগরি জ্ঞান কাজে লাগিয়ে নিজের কর্মসংস্থান নিজেই করতে পারছেন। কিন্তু যারা সাধারণ শিক্ষায় উচ্চতর ডিগ্রি সম্পন্ন করছেন তাদের কী হবে? তাদের একমাত্র উপায় চাকরি খোঁজা। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসা করা। যদিও সবাই ব্যবসার চেয়ে চাকরিই অধিক পছন্দ করেন। পরিস্থিতি এখন বহুগুণে বদলেছে। এখন বিনামূল্যে বই প্রদান, উপবৃত্তি, উপজেলা পর্যায়ে স্কুল ও কলেজ সরকারিকরণ, উপজেলা পর্যায়ে ডিগ্রির পাশাপাশি অনার্স করার সুযোগ রয়েছে। এসব কারণে লেখাপড়ার খরচও কমে এসেছে। নিজের এলাকায় থেকেই উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করার সুযোগ পাচ্ছেন তরুণরা। ফলে কেউ অল্প শিক্ষিত হয়েই লেখাপড়া ছেড়ে না দিয়ে বরং শেষ করতেই বেশি আগ্রহী। এসব সুযোগ-সুবিধা আজ একটি অসচ্ছল পরিবারের সন্তানকেও উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখায়। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি পূরণ হচ্ছে? দেশে উচ্চশিক্ষা নেয়ার জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বহুসংখ্যক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে। যদিও তার অনেকটিরই মান নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। নিজস্ব ক্যাম্পাসসহ অনেক শর্তই পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।

যাই হোক, উচ্চশিক্ষা মানে উচ্চ স্বপ্ন। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষা কি যুবকদের উচ্চ স্বপ্ন পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে? লেখাপড়া শেষে একটি চাকরির নিশ্চয়তা দিতে পারছে? যদি না পারে তাহলে উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটা কী? বেকার সমস্যা আমাদের দেশের একটি বড় সমস্যা। একসময় বলা হতো, ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়ায় চড়ে সে’। এ কথা আজকের সমাজে ধ্রুব সত্য নয়। যে লেখাপড়া করছে, সে গাড়ি ঘোড়া দূরে থাক, কোনোমতে তিন বেলা খেয়েপরে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা পাচ্ছে? শিক্ষিত বেকারের কষ্ট আরো বহুগুণে বেশি।

লেখাপড়া শেষে চাকরি না জোগাড় করতে পারলে তার পরিবার এবং সমাজের কাছে হেয় হতে হয়। চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করার পর যখন একজন চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নামে তখন কতজন উচ্চ শিক্ষিত যুবক শেষ পর্যন্ত সফল হচ্ছে? উচ্চশিক্ষা এখন আর কাজ পাওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। তরুণরা যত বেশি পড়ালেখা করছেন, তাদের তত বেশি বেকার থাকার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা পড়ালেখা শেষ করার পর কয়েকটি বছর কেবল চাকরি খুঁজেই কাটিয়ে দেন। তারপর চাকরির বয়স শেষ হলে কোনো কাজ বা ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন। সরকারি চাকরির সুযোগ খুব বেশি নেই। ফলে প্রধান ভরসা বেসরকারি খাত। কিন্তু সেই খাতেও নতুনদের আসতে নানা বাধা। ফলে উচ্চ শিক্ষিত হয়েও একজন তরুণ বেকার থাকছেন। 

উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কেউ বেকার বসে থাকতে চান না। কিন্তু বেকার থাকতে হয়। ক্রমেই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যারা তাদের মেধা দিয়ে দেশটাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে ভূমিকা রাখবেন তাদের কর্মহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানো হতাশার। এসব শিক্ষিত বেকার যুবকদের কর্মমুখী করতে নানামুখী উদ্যোগ নেয়া দরকার। এর মধ্যে অন্যতম হলো- এই প্রজন্মকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তোলা। ফ্রিল্যান্সিংসহ প্রযুক্তিতে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে নিজের শিক্ষা কাজে লাগিয়ে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নেয়া সম্ভব। শিক্ষিত এই প্রজন্মকে কাজের নিশ্চয়তা দিতে হবে। উন্নত দেশ গড়তে বেকার সমস্যা সমাধানে কাজের উপযুক্ত ক্ষেত্র গড়ে তোলার বিকল্প নেই।

লেখক: শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি - dainik shiksha এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন - dainik shiksha কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি - dainik shiksha ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028691291809082