শিশুদের পাঠাভ্যাস গড়ার প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষার্থীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারের এই প্রকল্প। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার এই প্রকল্পের শুরুতেই সিন্ডিকেট ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

ইতিমধ্যে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী বই বাছাই ও সংগ্রহ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অধীনে ‘স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ স্কিমের আওতায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য এই বই কেনা হচ্ছে। কিন্তু এতে অভিযোগ উঠেছে লেখক ও স্বনামধন্য প্রকাশনীকে বঞ্চিত করার। বিতর্কিত ব্যক্তিদের বই বাছাইয়েরও অভিযোগ উঠেছে। অনিয়মের শিকার হয়ে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। দুর্নীতি দমন কমিশনেও অভিযোগ করা হয়েছে প্রকাশকদের এই সংগঠনের পক্ষ থেকে। শুক্রবার (৯ জুন) মানবজমিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন পিয়াস সরকার।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন,  মৌখিকভাবে অভিযোগ শোনা গেলেও এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। লিখিত অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখা হবে। 

প্রকল্পে বই নির্বাচনে নানাবিধ অনিয়মের কথা জানিয়ে একাধিকবার শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও তৎকালীন শিক্ষা সচিব মো. আবুবকর ছিদ্দিক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছিল বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি। এতে বলা হয়, এই প্রকল্পে মূলধারার প্রকাশক বাদ দিয়ে নামে-বেনামে অসংখ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বই তালিকাভুক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এতে প্রকৃত ও মূলধারার প্রকাশকরা তাদের বহুদিনের প্রত্যাশিত প্রকল্প সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে সমিতির নেতৃবৃন্দ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ওই আবেদন ২১ এপ্রিল পাঠানো হয় তৎকালীন সচিবের কাছে। শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রতিকার চেয়ে তারা ফের আবেদন করেন ২ জুন ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে।

এরপরও সুফল না মেলায় দুর্নীতি দমন কমিশনের দ্বারস্থ হন তারা। দুদকে লিখিত বক্তব্যে সমিতি জানায়, বিগত ২৭/০৫/২০১১ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এসইডিপি)-এর আওতায় স্ট্রেংদেনিং রিডিং হ্যাবিট অ্যান্ড রিডিং স্কিলস অ্যামাং সেকেন্ডারি স্টুডেন্টস’ শীর্ষক স্কীমের আওতায় মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য আগ্রহী লেখক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনা আহ্বান করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬টি বইয়ের একটি তালিকা চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু সেই তালিকা প্রস্তুতে চূড়ান্ত অনিয়ম এবং দুর্নীতির আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে। বইয়ের তালিকা বিবেচনায় বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সদস্যদের নিকট স্পষ্ট যে, প্রকল্পের টাকা তছরুপ করার উদ্দেশ্যে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নামে-বেনামে কিছু সদস্য এবং নামসর্বস্ব প্রকাশক ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসহ তাদের সহযোগীদের মধ্যেই সকল বই নিয়মনীতি বহির্ভূতভাবে বণ্টন পূর্বক ক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এই তালিকায় ওসমান গনি (আগামী প্রকাশনী) চারটি, ফরিদ আহমেদ (সময় প্রকাশনী) চারটি, সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘অধুনার’ নামে একটি, আফজাল হোসেন (আনিন্দ্য প্রকাশনা) দুইটি, তারই সহযোগী প্রতিষ্ঠান আদিত্য প্রকাশনের নামে দুটি, এ.কে.এম নাসির আহমেদ সেলিম (কাকলি প্রকাশনী) দুটি, তারই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘প্রচলন’ একটি, আলো ভুবন একটি। এ ছাড়াও দীব্য প্রকাশনী নামে এবং সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে তিনটি, তাম্রলিপি নামে দুটি, সিদ্দিকীয়া প্রকাশনীর নামে দুটি, নওরোজ কিতাবিস্তানের নামে দুটি, জাগৃতি নামে দুটি বই তালিকার অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তালিকাভুক্ত করে সাধারণ প্রকাশকদের বঞ্চিত করা হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, আলোচ্য প্রকল্পের আনুমানিক অর্থ মূল্যের পরিমাণ সব মিলিয়ে ১০০ কোটি টাকার ঊর্ধ্বে এবং যা পরবর্তীতে ২০০ কোটি টাকায় উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা বিদ্যমান। এই প্রকল্পের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতের জন্য একটি মাইলফলক হতে পারতো। কিন্তু, দুর্নীতি এবং অনিয়মের মাধ্যমে বইসমূহ একটি সিন্ডিকেটের মধ্যে বণ্টন করে ফেলার কারণে সেই সুযোগ নষ্ট হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

অভিযোগপত্রে ১০৩ জন প্রকাশকের স্বাক্ষরসহ দুদকে জমা দেয়া হয়। এরপরও প্রতিকার না মেলায় উচ্চ আদালতে রিট করেন তারা। এতে স্বাধীনতাবিরোধী লেখকদের বই বাতিলসহ নতুন করে বইয়ের তালিকা প্রণয়নে চলতি বছরের ২১ মে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। রুলে ১৮ জুনের মধ্যে শিক্ষা সচিব, স্কিম পরিচালকসহ তিন জনকে জবাব দিতে বলা হয়েছে। রুলে বলা হয়, বই সংগ্রহ নীতিমালার ১৬ অনুচ্ছেদ ভঙ্গ করে বই সংগ্রহ, যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তালিকাভুক্তি হয়েছে কিনা এবং পুনরায় তালিকা কেন তৈরি করা হয়নি তা জানাতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

প্রথম ধাপে ১৫ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘কর্মসূচি বই’ ও ‘পুরস্কারের বই’ জন্য বরাদ্দ ছিল ৮৪ কোটি টাকা। প্রথম ধাপে ৯৩টি বই নির্বাচিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে এতে অনেক বিজ্ঞ লেখকের বই ঠাঁই পায়নি এই তালিকায়। বাদ গেছে একুশে পদক পাওয়া লেখকদের বইও। এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের জুন মাসে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রকাশকদের অভিযোগ, বাংলাবাজারের একটি প্রকাশনী সিন্ডিকেট ঘুষের মাধ্যমে বাড়তি বই বাগিয়ে নিয়েছে। কোনো কোনো প্রকাশনী নামে- বেনামে চার থেকে পাঁচটি বইয়ের কাজ পেয়েছে। একটি বইয়ের অনুমোদন হলে প্রায় এক কোটি টাকার কাজ মিলবে এসব প্রকাশনীর।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে পাঠানো পুস্তক সংগ্রহের নীতিমালার ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী কোনো লেখকের গ্রন্থ নির্বাচন করা যাবে না। প্রকাশকদের অভিযোগ, সরাসরি স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান করা কয়েকজন লেখকের বই শিশুদের পাঠ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। তাদের কেউ কেউ রবীন্দ্রসংগীত পাকিস্তানের আদর্শের বিরোধী বলে বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার রেডিও ও টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসংগীত প্রচার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিলে সে সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। মুক্তিযুুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষে বিবৃতি দিয়েছেন। প্রকাশকরা বলছেন, বাংলা একাডেমির চরিতাভিধানে তাদের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়।

আবার তালিকায় তিনটি ইংরেজি বইয়ের নাম থাকলেও এগুলোর প্রকাশক বা লেখকের নাম পাওয়া যায়নি। নাম দাখিলের বাধ্যবাধকতা দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তালিকা থেকে আরও দেখা যায়, সপ্তম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত ‘বুড়ো আংলা’ যার লেখকের নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত এই কিশোর সাহিত্যের বইটি ১৩৬ পৃষ্ঠার। চার কালারের এই বইটির মূল্য ধরা হয়েছে অস্বাভাবিক রকম বেশি দুই হাজার ৩১০ টাকা। অষ্টম শ্রেণির জন্য নির্বাচিত ২০টি বইয়ের মধ্যে তিনটি বই নিয়ে আছে অভিযোগ। ড. আলী আসগরের লেখা পৃথিবী বইটিকে বলা হচ্ছে বড়দের বই। প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর লেখা গল্প দাদুর আসর ও মোহাম্মদ নাসির আলীর লেখা বীরবলের খোশগল্প’র বই দুটির লেখক মুক্তিযুদ্ধ চেতনাবিরোধী। দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য নির্বাচিত বীরের এ রক্তস্রোত মাতার এ অশ্রুধারা, লাল নীল দীপাবলি/বাঙলা সাহিত্যের জীবনী, মুনীর চৌধুরী, নিসর্গ কথা- এই বইগুলো বড়দের পাঠযোগ্য বই।

এ বিষয়ে স্কিম উপ-পরিচালক আনিছুল আহসান কবীর বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী লেখকের বই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়টি আমরা শুনেছি। এ বিষয়ে কোনো অভিযোগ এলে আমরা তা মন্ত্রণালয়ে জানাবো।

বই বাছাই কমিটির আহ্বায়ক মো. বেলায়েত হোসেন তালুকদার বলেন, বই বাছাইয়ের জন্য আমাদের ডাকা হয়। প্রথমে কয়েকটি সভাও হয়। এরপর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এরপর আমরা শুনেছি বই বাছাইয়ের জন্য বড় বড় মানুষদের যুক্ত করা হয়েছে। তখন আমরা ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সেখান থেকে সরে আসি। 

জানা যায় এরপর এই বই বাছাই কমিটিতে যুক্ত হন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা। তার নেতৃত্বেই মূলত বই বাছাই হয়। তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সাড়া মেলেনি। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে স্কিম পরিচালক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বলেন, আমরা স্কিম থেকে বইগুলো কিনবার জন্য মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা পেয়েছি। মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞ প্যানেলে সিদ্ধান্ত মতেই তালিকাটি তৈরি হয়। তাদের সিদ্ধান্ত মতেই আমরা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করি। তারা অনেকগুলো মিটিংয়ের পর এই তালিকা চূড়ান্ত হয়। এই অনুমোদিত তালিকা নিয়ে কাজ করছি। এরপর যদি কোন অভিযোগ থাকে সেটা মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেবে আমরা সেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবো।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘বারাসাত ব্যারিকেড’ ঘোষণা তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ‘বারাসাত ব্যারিকেড’ ঘোষণা তিতুমীর কলেজ শিক্ষার্থীদের রাতারাতি সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব না - dainik shiksha রাতারাতি সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব না মনোনীত হয়েও বৃত্তি থেকে বঞ্চিত রাবির ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী - dainik shiksha মনোনীত হয়েও বৃত্তি থেকে বঞ্চিত রাবির ৯ শতাধিক শিক্ষার্থী পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার বেরোবির সাবেক প্রক্টর - dainik shiksha আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার বেরোবির সাবেক প্রক্টর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে মাদরাসা-ই-আলিয়ার ভবনে অস্থায়ী আদালত বন্ধের দাবি - dainik shiksha মাদরাসা-ই-আলিয়ার ভবনে অস্থায়ী আদালত বন্ধের দাবি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়ে নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি নিয়ে নতুন নির্দেশনা বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.018501996994019