শীতে অনেকেরই ঠান্ডা লাগার সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে এ উপসর্গ করোনাভাইরাসের কারণেও হতে পারে। ঠান্ডা লাগার উপসর্গ সাধারণত ২ থেকে ৩ দিনের বেশি না থাকলেও করোনাভাইরাসের উপসর্গ ২ সপ্তাহ বা তারও বেশি থাকতে পারে। আর দেশে ক্রমেই বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। সর্বশেষ হিসাবে ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৩০ জনের শরীরে ভাইরাসটি শনাক্ত হয়েছে। এ সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে একজনের মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে। এ নিয়ে চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে করোনায় ৪ জনের মৃত্যু হলো। করোনা মহামারির শুরু থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ভাইরাসটিতে মোট মৃত্যুর হয়েছে ২৯ হাজার ৪৮১ জনের আর সংক্রমিত হয়েছেন ২০ লাখ ৪৬ হাজার ৭৮৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাঠানো করোনাবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গত সোমবার জানানো হয়, সারা দেশে ৮৮৫টি পরীক্ষাগারে ৫৮৪টি নমুনা পরীক্ষায় ৩০ জনের দেহে করোনা শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ২৬ জন ঢাকার এবং দুজন চট্টগ্রামের বাসিন্দা। বাকি দুজন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দা।
এ সময় করোনা আক্রান্তদের মধ্যে থেকে সেরে উঠেছেন ৮ জন। এ নিয়ে মহামারির শুরু থেকে মোট সুস্থ রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ১৪ হাজার ১৭৯ জনে। সুস্থতার হার ৯৮ দশমিক ৪১ শতাংশ। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডও-মিটারের গত ১৯ ডিসেম্বরের অনুযায়ী বিশ্বে করোনায় এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৬৯ লাখ ৫৭ হাজার ৬০১ জনের। সুস্থ হয়েছেন ৬৬ কোটি ৯৪ লাখ ৭১ হাজার ২৮৮ জন। এ ভাইরাসে মোট সংক্রমিত হয়েছেন ৬৯ কোটি ৯৭ লাখ ৩৯ হাজার ৩৭৪ জন।
মৃদু উপসর্গের কারণে অনেকে শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি টের পান না। পরে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যা জানান দেয়, কোনো না কোনো সময় শরীরের সঙ্গে কোভিডের যুদ্ধ হয়েছিলো। মহামারির পরই লং কোভিড শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটেছে। কোভিড কখনো হয়নি এমন মানুষের ক্ষেত্রেও ইদানিং লং কোভিডের কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এসব লক্ষণ দেখলে বুঝে নিতে হবে কোনো না কোনো সময় শরীরে প্রবেশ করেছিলো করোনাভাইরাস। লক্ষণ না থাকায় কোনো সময় টের পাওয়া যায়নি। তবে শরীর একটু অসুস্থ হলেই লং কোভিডের বিভিন্ন লক্ষণ ফুটে ওঠে।
এখন তীব্র শীতের মৌসুম। ফলে ঠান্ডা লাগাটা স্বাভাবিক। তবে এই ঠান্ডাজনিত সর্দি-কাশি যদি দুই সপ্তাহেও ভালো না হয় তাহলে বুঝে নেবেন করোনাভাইরাস আপনার শরীরেও হানা দিয়েছিলো। শ্বাসকষ্ট কোভিডের লক্ষণ। তবে ঠান্ডা লাগলেই শ্বাসকষ্ট হওয়াটা স্বাভাবিক নয়। সহজে শ্বাস নিতে না পারার সমস্যা কোভিডের জন্য হয়ে থাকতে পারে। এ ধরনের শ্বাসকষ্ট অনেক দিন থাকে, সহজে সারে না। এ ছাড়া, শুকনা কাশি যাচ্ছেই না বা খুব ধীরে কমছে-এমনটা দেখলে ধরে নিতে পারেন কোভিডে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এ ধরনের কাশি খুব অল্প অল্প করে বাড়ে। পরে অবস্থা শোচনীয় হয়।
সাধারণত কনজাংকটিভাইটিসের কারণে চোখ লাল হয় এবং চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এই কারণ ছাড়া অন্য কোনো সমস্যায় চোখ দিয়ে পানি পড়লে বা চোখ লাল হয়ে থাকলে তা কোভিড পরবর্তী লক্ষণ। কারণ, করোনাভাইরাস একসময় চোখকেও প্রভাবিত করেছিলো। এমনকি কোভিড হার্টকে আক্রমণ করে। এতে হৃৎস্পন্দনের গতি বাড়ে, অনেকটা পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো। বুকে চাপ অনুভূত হয়। ভাইরাস চলে যাওয়ার দুই সপ্তাহ পর হতে পারে আবার, গুরুতর হলে ছয় মাস পরও হার্টের সমস্যা হতে পারে।
কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হলে প্রবল ক্লান্তি বোধ হওয়া খুব স্বাভাবিক। এ রকম বোধ করলে ঘুম হলেও ক্লান্তি দূর হয় না। এই অনুভূতি ফিরে আসতে পারে দুই সপ্তাহ কিংবা তারও পরে। অনেক সময় খাবার আর পানীয় যদি বিস্বাদ লাগে, খাবারের গন্ধ পাওয়া না যায়, তবে তার জন্য কোভিড দায়ী হতে পারে। মৃদু সংক্রমণেও ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে খাবারে অরুচি দেখা দেয়। ওপরের প্রতিটি লক্ষণই অনুমানভিত্তিক। যদি নিশ্চিত হতে চান তবে অ্যান্টিবডি টেস্ট করাতে হবে। অ্যান্টিবডি টেস্টই প্রমাণ করে দেবে কোভিড হয়েছিলো কি না।
বেশ কিছুদিন ধরে করোনা সংক্রমণের হার নিম্নমুখী থাকলেও হঠাৎ করে তা বাড়তে শুরু করেছে। ইতালি, স্পেন, কিউবা ও ভারতসহ বিভিন্ন দেশে হোমিও চিকিৎসার মাধ্যমে অতি দ্রুততার সঙ্গে বহু করোনা রোগী সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করেছেন। গত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ প্রয়োগ করে এমনি একটি আশানুরূপ নজির স্থাপিত হয়েছে পুরান, ঢাকার স্বামীবাগে অবস্থিত ইসকন মন্দিরে। মাত্র ৭ দিনের হোমিও ওষুধ প্রয়োগ করে সুস্থ হয়েছেন ইসকন মন্দিরের পুরোহিতসহ ৩৫ জন করোনা রোগী। এ মন্দিরের করোনা রোগীদের সুস্থ হওয়ার পেছনে হোমিওপ্যাথির সাফল্য যদি আমরা পরীক্ষামূলক হিসেবেও গ্রহণ করি, তাহলে পরবর্তীতে দেখা যায় ঢাকার রাজারবাগ সেন্ট্রাল পুলিশ হসপিটালের করোনা ওয়ার্ডের ৪২ জন রোগী শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথি ওষুধ সেবনের মাধ্যমে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছেন এক সপ্তাহের মধ্যেই। যা সম্পূর্ণ কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি রূপেই প্রতীয়মান হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে করোনার লক্ষণ উপসর্গ নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই স্বল্প খরচে হোমিও ওষুধ সেবনের মাধ্যমে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছেন। বাংলাদেশের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা ইতোমধ্যেই সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। ফল স্বরূপ আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বিশেষ করে পুলিশ বিভাগ হোমিও সেবা গ্রহণ করছেন এবং সুস্থও হচ্ছেন। করোনা সংক্রমণের শুধুমাত্র প্রাথমিক পর্যায়েই নয় বরং একেবারে চরম পর্যায়ে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন অবস্থায়ও হোমিও চিকিৎসার সক্ষমতা রয়েছে। এ অবস্থায় এসব রোগীর চিকিৎসায় লক্ষণভিত্তিক হোমিও ওষুধ প্রয়োগের মাধ্যমে রোগীর জীবন রক্ষা করার পাশাপাশি রোগীর স্বাস্থ্য পুনর্বাসনে সহায়তা করা যেতে পারে।
করোনাভাইরাসের কারণে হৃদযন্ত্রেরও ক্ষতি হতে পারে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে হার্টবিট বেড়ে যেতে পারে। আপনি বুকে চাপ অনুভব করতে পারেন। ভাইরাস আপনার দেহ থেকে দূর হওয়ার পরেও এরকম হতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ মধ্যম পর্যায়ে ২ সপ্তাহ পর্যন্ত এবং গুরুতর পর্যায়ে ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে।
করোনাভাইরাস তীব্র অবসাদের সৃষ্টি করে। যদি আপনি অনেক বেশি ক্লান্তি অনুভব করেন এবং বিশ্রাম নেয়ার পরেও সেই ক্লান্তি দূর না হয়, তাহলে এর পেছনে কারণ হিসেবে ভাইরাস দায়ী হতে পারে। কয়েক দিন বা কয়েক সপ্তাহ পরে আবারো এরকম অনুভূতি ফিরে আসতে পারে।
করোনাভাইরাসের কারণে খাবার ও পানীয়ের স্বাদ অন্যরকম লাগতে পারে। আপনি একেবারেই কোনো স্বাদ বা গন্ধ নাও পেতে পারেন। এ ধরনের পরিস্থিতি কয়েক সপ্তাহ ধরে চলতে পারে। এই উপসর্গ দেখা দিলে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে করোনাভাইরাস পরীক্ষায় ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় এবং এটি সাধারণত মধ্যম পর্যায়ের করোনাভাইরাস নির্দেশ করে।
দেহে যেকোনো ধরনের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, যেটি মূলত এক ধরনের প্রোটিন। অবস্থাদৃষ্টে ধারণা করা হচ্ছে, মিউটেশনের কারণে করোনাভাইরাসের উপসর্গ বা প্রভাবে খুব বেশি পরিবর্তন আসে না। নতুন স্ট্রেইনগুলো তুলনামূলকভাবে দ্রুত ছড়াতে পারে, কিন্তু উপসর্গগুলো অনেকটা আগের স্ট্রেইনের মতোই থাকে। সুতরাং করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও শুধু উপসর্গ থেকে বোঝা যাবে না আপনি কোন স্ট্রেইনে আক্রান্ত হয়েছেন। আর যেহেতু আমাদের বাংলাদেশে পরিবেশ দূষিত, তাই সরকারের দিকে তাকিয়ে না থেকে নিজের সুরক্ষা নিজেকেই নিতে হবে। ধুলোবালি থেকে বাঁচতে মাস্ক পরতে হবে। হাত স্যানিটাইজ করতে হবে। একটা ভাইরাস দেহে থাকতে, আরেকটি প্রবেশ করলে তখন ওই ব্যক্তির সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হয়। এ জন্য ঘরেও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।
জনবহুল এলাকা, ভিড় থেকে শিশুকে যতোটা সম্ভব দূরে রাখুন। কোভিডকালের মতোই মুখে মাস্ক এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর আবারো জোর দেওয়া উচিত। এই রোগ ছোঁয়াচে। সুতরাং, সাবধানতা অবলম্বন না করলে, বিপদ বাড়বেই। এই মৌসুমে ঘোরাঘুরি, উৎসব, অনুষ্ঠান বেড়ে যায়। তাই, যেকোনো রকম জনসমাগম, উৎসব, অনুষ্ঠান, ভিড় এড়িয়ে চলুন। উৎসব অনুষ্ঠান করতেই হলে সীমিত পরিসরে অল্পসংখ্যক মানুষকে নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। সুস্থ থাকতে এবং চারপাশের মানুষকে সুস্থ রাখতে করোনাভাইরাসের উপসর্গ সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুবই জরুরি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।