শীতে সাইনোসাইটিসের কারণ ও প্রতিকার

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ |

ধীরে ধীরে ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে বাড়ে সাইনাসের সমস্যাও। নাক-কানের কিছু সমস্যা শীতকালেই হয়। আর কিছু সমস্যা শীতে বাড়ে। শীতের মৌসুমে সর্দি-কাশি-হাঁচি বা নাক বন্ধ হওয়ার সমস্যা হতেই পারে। কারো কারো এমন সমস্যায় পুরো শীতকাল ভুগতে হয়। এর কারণ ঠান্ডায় সংবেদনশীলতা বা কোল্ড অ্যালার্জি। আমাদের নাকের চারপাশের অস্থিগুলোর ফাঁকে বাতাসপূর্ণ কুঠুরি থাকে। এগুলোকে বলে সাইনাস। এর কাজ হলো মাথাকে হালকা রাখা, আঘাত থেকে মাথাকে রক্ষা করা, কণ্ঠস্বরকে সুরেলা রাখা, দাঁত ও চোয়াল গঠনে সহায়তা করা। সাইনাসের ভেতরের মিউকাস (তরল) স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিদিন নাসিকা গহ্বর দিয়ে বেরিয়ে যায়। নাকের ভেতর দিয়ে সাইনাসে বাতাস চলাচল করে। এ প্রক্রিয়ায় বিঘ্ন ঘটলে বাতাসের পরিবর্তে সেখানে পানি বা তরল পদার্থ জমা হয়ে প্রদাহ হয়। একে সাইনোসাইটিস বলা হয়।

নাকে এলার্জির সমস্যা, ভাইরাস সংক্রমণ, মৌসুম পরিবর্তনজনিত সাধারণ ঠান্ডা-সর্দি, নাকের মাঝখানের হাড় বাঁকা হওয়া, নাকের ভেতরে মাংস (টারবিনেট) বৃদ্ধি, পলিপ, টিউমার ইত্যাদি কারণে সাইনোসাইটিস হয়। শীত বা এর শুরুতে অ্যালার্জি, ঠান্ডা ও ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি হয়। যাদের এ সমস্যাগুলো আছে, তাদের ক্ষেত্রে রোগটির প্রকোপ এ সময় বেশি দেখা দেয়।

সাইনাস খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। এই সমস্যায় প্রায় আমরা প্রত্যেকেই ভুগি। বিভিন্ন ইনফেকশন, অ্যালার্জি থেকে সাইনাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এর ফলে আমরা মাথার যন্ত্রণা, মুখমণ্ডলে যন্ত্রণা, নাক থেকে পানি পড়া এবং নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যায় পড়ি। সাইনাস সাধারণত বায়ুপূর্ণ মিউকাস পর্দায় আবৃত এবং ক্ষুদ্র নালির মাধ্যমে নাসাগহ্বর তথা শ্বাসনালির সঙ্গে যুক্ত থাকে। এসব সাইনাস যদি বাতাসের বদলে তরল পদার্থে পূর্ণ থাকে এবং এই তরল যদি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকে সংক্রমিত হয় তখন সাইনাসের মিউকাস পর্দায় প্রদাহের সৃষ্টি হয়। ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাকের সংক্রমণে বা এলার্জিজনিত কারণে সাইনাসের মিউকাস পর্দায় যে প্রদাহের সৃষ্টি হয় তাকেই সাইনুসাইটিস বলে। সাইনুসাইটিসের কারণে মাথা ব্যথা, মুখমন্ডলে ব্যথা, নাক দিয়ে ঘন হলদে বা সবুজাভ তরল ঝরে পড়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।

মাথার খুলিতে মুখমন্ডলীয় অংশে নাসাগহ্বরের দুপাশে অবস্থিত বায়ুপূর্ণ চার জোড়া বিশেষ গহ্বরকে সাইনাস বা প্যারান্যাসাল সাইনাস বলে।  এগুলো হলো-১. ম্যাক্সিলারি সাইনাস  ম্যাক্সিলারি অঞ্চলে গালে অবস্থিত ২. ফ্রন্টাল সাইনাস: চোখের ওপরে অবস্থিত ৩. এথময়েড সাইনাস: দু’চোখের মাঝখানে অবস্থিত ৪. স্ফেনয়েড সাইনাস: এথময়েড সাইনাসের পেছনে অবস্থিত।

স্থায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে সাইনোসাইটিস দু’রকম। ১. অ্যাকিউট সাইনোসাইটিস: এর স্থায়িত্ব ৪ থেকে ৮ সপ্তাহ ২. ক্রনিক সাইনোসাইটিস। এর স্থায়িত্ব ২ মাসের বেশি সময়।

মানুষের শ্বাসযন্ত্রের সিনসাইটিয়াল ভাইরাস, প্যারাইনফ্লুয়েজা ভাইরাস, মেটাপনিউমো ভাইরাস), ব্যাকেটেরিয়া (স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া, হিমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা) এবং কিছু ক্ষেত্রে ছত্রাকে আক্রান্ত হলে সাইনোসাইটিস হতে পারে।

ঠাণ্ডাজনিত কারণে, অ্যালার্জিজনিত কারণে, ব্যবধায়ক পর্দার অস্বাভাবিকতায় সাইনাস গহ্বর অবরুদ্ধ হয়ে, নাকে পলিপ সৃষ্টি হলে, নাসাগহ্বরের মিউকোসা স্ফীতির ফলে নাসাপথ সরু হয়ে ক্রনিক সাইনোসাইটিস হতে পারে।

দাঁতের ইনফেকশন থেকে বা দাঁত তুলতে গিয়েও সাইনাসে সংক্রমণ হতে পারে।

যারা হাঁপানির সমস্যায় ভোগেন তাদের দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস দেখা যায়।

সাধারণত ঘরের পোকামাকড়, ধুলাবালি, পেস্ট, তেলাপোকা ইত্যাদি যেসব অ্যালার্জেন ধারণ করে তার প্রভাবে এ রোগের সংক্রমণ দেখা দিতে পারে।

ইউস্টেশিয়ান নালির সামান্য অস্বাভাবিকতায় সাইনাস গহ্বর অবরুদ্ধ হয়ে এবং সংক্রমণের ফলে সাইনোসাইটিস হতে পারে।

নাকের হাড় বাঁকা থাকলে অথবা মুখগহ্বরের টনসিল বড় হলে এ রোগ হতে পারে। সিস্টিক ফাইব্রোসিস এর কারণে এ রোগ হয়।

অপুষ্টি, পরিবেশ দূষণ ও ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের কারণেও এ রোগ হতে পারে।

১. নাক থেকে হলদে বা সবুজ বর্ণের ঘন তরল বের হয়। এতে পুঁজ বা রক্ত থাকতে পারে।
২. দীর্ঘ ও বিরক্তিকর তীব্র মাথা ব্যথা লেগেই থাকে যা সাইনাসের বিভিন্ন অঞ্চলে হতে পারে।
৩. মাথা নাড়াচাড়া করলে, হাঁটলে বা মাথা নিচু করলে ব্যথার তীব্রতা আরো বেড়ে যায়।
৪. জ্বর জ্বর ভাব থাকে, কোন কিছু ভালো লাগে না বরং অল্পতেই ক্লান্ত লাগে।
৫. নাক বন্ধ থাকে, নিঃশ্বাসের সময় নাক দিয়ে বাজে গন্ধ বের হয়।
৬. মুখমন্ডল অনুভূতিহীন মনে হয়।
৭. মাথাব্যথার সাথে দাঁত ব্যথাও হতে পারে।
৮. কাশি হয়, রাতে কাশির তীব্রতা বাড়ে, গলা ভেঙ্গে যায়।

সাইনুসাইটিস সংক্রান্ত জটিলতা কেবল নাসিকাগহ্বর ঘিরেই অবস্থান করে না, বরং সাইনাসগুলোর অবস্থান চোখ ও মস্তিষ্কের মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল অঙ্গের সংলগ্ন হওয়ায় জীবাণুর সংক্রমণ শুধু সাইনাসেই সীমাবদ্ধ না থেকে রক্তবাহিত হয়ে চোখ ও মস্তিষ্কে পৌঁছালে মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্কে সংক্রমণের ফলে মাথাব্যথা, দৃষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। চোখে সংক্রমণের ফলে পেরিঅরবিটাল ও অরবিটাল সেলুলাইটিসসহ আরও অনেক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস নিম্নলিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ণয় করা যেতে পারে। যেমন-
শারীরিক পরীক্ষা: ডাক্তার রোগীকে শারীরিকভাবে পরীক্ষা করবেন, রোগীর উপসর্গ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, মুখ বা নাকের কোমলতা পরীক্ষা করবেন এবং নাকের ভেতর দেখবেন। ডাক্তার রোগীর অতীত এবং বর্তমান চিকিৎসা অবস্থা সম্পর্কেও জিজ্ঞাসা করেন।

ইমেজিং পরীক্ষা: সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই স্ক্যানের মতো পরীক্ষাগুল অনুনাসিক এবং সাইনাস এলাকার বিশদ বিবরণ দেখায়। এটি টিউমার, ছত্রাক বা পলিপের মতো প্রদাহ বা শারীরিক অবরোধ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে, যা এন্ডোস্কোপি ব্যবহার করে সনাক্ত করা কঠিন হতে পারে।

এন্ডোস্কোপি: ডাক্তারকে সাইনাসের ভেতরে দেখতে দেয়ার জন্য নাকের মধ্য দিয়ে ফাইবার-অপটিক আলোসহ একটি দীর্ঘ, পাতলা, নমনীয় টিউব ঢোকানো হয়। এটি একটি বিচ্যুত অনুনাসিক সেপ্টাম, টিউমার বা পলিপ নির্ণয়ে সাহায্য করতে পারে। 

অ্যালার্জি পরীক্ষা: অ্যালার্জি দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিস হতে পারে বলে মনে করা হলে একটি অ্যালার্জি ত্বক পরীক্ষার সুপারিশ করা যেতে পারে। এই পরীক্ষাটি কী অ্যালার্জেনগুলো অনুনাসিক ফ্লেয়ার-আপ সৃষ্টি করছে তা সনাক্ত করতে সহায়তা করে।
সংস্কৃতি: ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাকের মতো দীর্ঘস্থায়ী সাইনোসাইটিসের কারণ নির্ধারণের জন্য অনুনাসিক এবং সাইনাস স্রাব থেকে নমুনা নেয়া হয়।

প্রাথমিক চিকিৎসা কিংবা ওষুধের মাধ্যমে প্রতিকার না পেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে পরবর্তী পদক্ষেপ নিন।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি 

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030620098114014