আজকের সময়ে মেধাকে রীতিগত বা প্রথাগত সংজ্ঞায় আবদ্ধ করার সুযোগ নেই। অর্থাৎ শুধু পুঁথিগত বিদ্যায় কাউকে মেধাবী এবং কাউকে মেধাহীন বলার বা বিবেচনা করার কারণ নেই। যদিও দ্রুত বর্ধনশীল ও ঘনবসতির এই জনপদে এখনো সার্টিফিকেটসর্বস্ব শ্রেণিকেই মেধাবী হিসেবে বিবেচনার চর্চা আছে।
অথচ মেধা যাচাইয়ে পাশ্চাত্যের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিস্তৃত অর্থে বললে, বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ছিলেন একজন জড় বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। তাঁকে স্কুল থেকে পর্যন্ত বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, তিনি তাঁর মায়ের তত্ত্বাবধানে গৃহে বসেই শিক্ষা লাভ করেন এবং শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই তাঁর আবিষ্কারের পেটেন্ট সংখ্যা ১০৯৩! রোববার (২৪ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ভারতের ওড়িশায় জন্ম নেওয়া হলধর নাগ তৃতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনায় ইস্তফা দেন। এরপর পরিবারের মুখে ভাত দিতে গ্রামের হাই স্কুলের হোস্টেলে রাঁধুনির কাজ শুরু করেন। পরে স্কুলের শিক্ষকদের পরামর্শে স্কুল গেটের পাশে ছোট বই-খাতার দোকান দিয়ে বসেন। আর সেখানে বসেই লেখেন আচিয়া, বাছার, মহাসতী উর্মিলা, তারা মন্দোদরী, শিরি সামালাই, প্রেম পইচান, বীর সুরেন্দ্র সাই, শান্ত কবি বিমাভাই ২০টি মহাকাব্য। যা নিয়ে এখন পর্যন্ত দেশে-বিদেশে পাঁচজন পিএইচডি করেছেন এবং ১৪ জন গবেষক এখনো গবেষণা করছেন।
বাংলার বাউল সম্রাট লালন শাহ অথবা গাঁয়ের সেই আরজ আলী মাতুব্বরও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। তবু কী গভীর জীবনবোধ ও দর্শন রচনা করে গেছেন, যা আজও পাঠ্য ও পাথেয়। এসব সম্পদ সম্পর্কে না জেনে এর পরও যারা মেধাকে শুধু একপক্ষীয় সার্টিফিকেটে আবদ্ধ রাখতে তৎপর, তারা হয়তো আপন স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতেই এমন অজুহাত সামনে আনেন। গভীর পর্যবেক্ষণে বিচার করলে, আপন স্বার্থকে সুরক্ষিত এবং নিজেদের প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশে বলবৎ রাখতেই এমন কৌশল! অথচ বাঙালি সংস্কৃতি বহুত্ববাদের মাধুর্যে নন্দিত। আউল-বাউল, সাধু সর্বশ্রেণির অংশগ্রহণে ঋদ্ধ। কাজেই সবটাকে সুযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসাটাই মুখ্য।
অভিভাবকদেরও এই বিষয়গুলো জানা জরুরি যে মেধার বিচার যদি শুধুই সার্টিফিকেটের বিচারে হতো, তাহলে বিশ্বে বহু বিষয়ের আবিষ্কারই হতো না। আজকের সময়ে প্রাসঙ্গিক হতো না। যেমন—ক্রিকেট, ফুটবলসহ অনেক খেলা ও পেশা। কাজেই নিজেদের প্রশ্ন উত্থাপন জরুরি যে শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, পেলে, ম্যারাডোনা—তাঁদের মেধাবী হিসেবে যাচাই করবেন কি না। অর্থাৎ মেধার বিকাশকে একপক্ষীয় উঠোন থেকে সরিয়ে বহুত্ববাদের বাগানে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি এবং চর্চার চেষ্টা করবেন কি না?
পাশাপাশি সকাল থেকে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের যে পড়াশোনার চাবুক দিয়ে তাড়া করার মানসিকতাও পরিহার করা জরুরি। কারণ বয়সের পরিপক্বতা অনুযায়ী মা-বাবাই বুঝতে পারেন সন্তানের আগ্রহ কিংবা স্বতঃস্ফূর্ততা কোন দিকে বেশি। সে হিসেবেই সন্তানকে পরিচর্যা এবং গড়ে তোলা উচিত। এ ক্ষেত্রে মা-বাবার জগৎও বড় হতে হবে। কারণ মা-বাবা যদি কেরানিগিরির বাইরে কোনো জগৎ সম্পর্কে না জানেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবে সন্তানকেও সেই গণ্ডির বাইরে আনতে পারবেন না। অর্থাৎ সন্তানের বিকাশের আগে মা-বাবার বিকাশ জরুরি।
এসব করতে পারলে কোনো সন্তান জিপিএ ৫ না পেলেও মা-বাবা সন্তানকে মিষ্টিমুখ করাবেন। গর্ব করে বলবেন তাঁর সন্তান খেলোয়াড়, সংগীতজ্ঞ, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, চিত্রশিল্পী, সাহিত্যিকসহ ভিন্ন কিছু হতে চায়। শৈশবে খেলাধুলা ও পড়াশোনার স্থল বিকেএসপিতে ভর্তি করাতে চান। আর ফলাও করে জানাতে হবে, প্রয়োজনে বিজ্ঞাপন দিতে হবে সবাই আইনস্টাইন, চমস্কি, অমর্ত্য সেন না হলেও চলবে। আর এটা না হলেও সে মেধাহীন বলে বিবেচিত হবে না। যাঁরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, স্টিভ জবস, আব্রাহাম লিংকন কিংবা লতা মুঙ্গেশকর হবেন তাঁরাও মেধার বিচারে মেধাবী।
পাশাপাশি শুধু ব্যাকরণগত আচ্ছাদনের মোড়কে যারা প্রতিভা ও মেধার বিকাশকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়, নিজেদের স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে চায় তাদের সম্পর্কে জাতিকে জানাতে হবে। তাদের জগৎ ও যোগ্যতা সম্পর্কেও জানাতে হবে। আর জাতিকে সমৃদ্ধ করতে মেধাকে যে ব্যাকরণের বাইরে গিয়েও বহুত্ববাদের আহবান আকাশে মেলে ধরতে হয়, সেটারও আত্মস্থ ও চর্চার চল করা জরুরি। এটা করতে পারলে বাঙালি সংস্কৃতি, শিক্ষা এবং জগৎ হবে আরো বৈচিত্র্যময়, নান্দনিক।
লেখক : রাবেয়া রাবু, প্রাবন্ধিক ও গবেষক