বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস, ওপারেতে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস।’ এটি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। যে যে পেশাতেই আছেন তারা সেই পেশাকে তূলনা করেন নিজ দেশের অন্যান্য পেশার সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে এবং বিদেশের সঙ্গে। ফেসবুক খুললে দেখা যায়, অনেকেই লেখেন, অমুক দেশে শিক্ষকদের বেশি বেতন দেয়া হয়, অমুক দেশে একমাত্র শিক্ষকদেরকে আদালতে চেয়ারে বসতে দেয়া হয় ইত্যাদি। চাকরির সুবাদে, নিজ আগ্রহে ও গবেষণার কাজে আমার কয়েকটি উন্নত, কয়েকটি উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে। শিক্ষকদের সঙ্গে, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, শিক্ষা প্রশাসকদের কথা বলেছি। আমি যতোটা দেখেছি শিক্ষকতার অবস্থা সেই অর্থে হতেগোনা দুয়েকটি দেশ ছাড়া কোথাও খুব একটা ভালো নেই। ইংল্যান্ডের কথায়ই যদি আসি, সেখানকার শিক্ষক ও শিক্ষা প্রশাসকদের সঙ্গে কথা বলেছি।
আন্তর্জাতিক পত্রিকায় আমরা দেখেছি, ইংল্যান্ডজুড়ে শিক্ষকরা তাদের বেতন বৃদ্ধির দাবিতে ধর্মঘট করেছেন এবং এই ধর্মঘট এক সপ্তাহে তারা দ্বিতীয়বারের মতো করেছেন। ফলে দেশজুড়ে হাজার হাজার স্কুলের কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। শিক্ষক নেতারা বলেছেন, সমস্যার সমাধানে না পৌঁছালে অনির্দিষ্টকালের জন্য অব্যাহত থাকতে পারে তাদের ধর্মঘট। যুক্তরাজ্যে বহুদিন ধরেই সরকারি স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে বেতন ও ভাতা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ ও ক্ষোভ রয়েছে। সেই ক্ষোভ সম্প্রতি বিক্ষোভ-প্রতিবাদে রূপ নিয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে প্রথম ধর্মঘটের ডাক দেন শিক্ষকদের সংগঠন ন্যাশনাল এডুকেশন ইউনিয়ন (এনইইউ)। প্রায় তিন লাখ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী এই ধর্মঘটে সমর্থন দেন। সরকার এর আগে শিক্ষকদের এক হাজার পাউন্ড এককালীন নগদ অর্থ দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
আরো একটি সংবাদ আন্তর্জাতিক মাধ্যমসহ বাংলাদেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তায় ছাপা হয়েছে, স্কুলের শিক্ষট সংকট কাটাতে যুক্তরাজ্য সরকারের বৈশ্বিক উদ্যোগ অনেকটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে দেশটির স্কুল শিক্ষকদের গণহারে পেশা পরিত্যাগের ফলে ওই সংকট প্রবল হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ডিসেম্বরে (২০২২) নয়টি দেশ থেকে লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগের পরিকল্পনা করেছিলো তারা। বিদেশি শিক্ষকদের কর্মজীবনের শুরুতেই উচ্চ আর্থিক প্রণোদনা ও আকষর্ণীয় বেতনের ঘোষণা দিয়েছিলো কিন্তু কঠোর নিয়োগ প্রক্রিয়া যোগ্য প্রার্থীর অভাবে গত ছয়মাসে তারা লক্ষ্যের ধারে কাছেও যেতে পারেনি। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। একটি হচ্ছে ওইসব দেশে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া বেশ জটিল অথাৎ যে কেউ ইচ্ছে করলেই শিক্ষকতার খাতায় নাম লেখাতে পারেন না। দ্বিতীয় হচ্ছে, উপযুক্ত প্রার্থী না পাওয়া গেলে পোস্ট খালি থাকছে, যাকে তাকে দিয়ে পোস্ট পূরণ করা হচ্ছে না। এ ছাড়া, কমন একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, শিক্ষক সংকট শুধুমাত্র অনুন্নত আর উন্নয়নশীল বিশ্বের সমস্যাই নয়, এটি উন্নত বিশ্বেরও একটি সমস্যা। এখানে আর একটি বিষয় লক্ষণীয় সেটি হচ্ছে বিদেশ থেকে শিক্ষক নেয়ার সংস্কৃতি। এটির আলাদা একটি ইমপ্লিকেশন আছে। বিদেশি শিক্ষকদের কাছ পড়া মানে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা, নতুন ধরনের লার্নিং, নতুন ধরনের সিরিয়াসনেস, নতুন কালচারের সঙ্গে পরিচিত হওয়া। আমাদের প্রধানমন্ত্রীও বলেছিলেন দেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রয়োজন হলে বিদেশ থেকে শিক্ষক নিয়ে আসবেন। আমার মনে আছে দেশে শিক্ষকদের যেভাবে প্রশিক্ষণ দিতাম, তার চেয়ে দেশের বাইরে শিক্ষকদের মধ্যে আলাদা এক ধরনের উচ্ছ্বাস ও সিরিয়াস লক্ষ্য করেছি। এর কারণ আলাদা কালচার, আলাদা অভিজ্ঞতা।
সম্প্রতি ব্রিটেনের সরকার শিক্ষকদের পদত্যাগ ঠেকাতে কর্মজীবনের শুরুতেই প্রত্যেককে দুই হাজার চারশ পাউন্ড করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে , যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় তিন লাখ ত্রিশ হাজার টাকার সমান। এ ঘোষণা শিক্ষকদের পেশায় ধরে রাখতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী তারা। এজন্য ৫০ মিলিয়ন অতিরিক্ত পাউন্ড প্রয়োজন হবে। আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত খবরে দেখা যায় যে, ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলের শিক্ষক হিসেবে পেশা শুরু করা প্রতি পাঁচ শিক্ষকের মধ্যে একজন করোনা পরিস্থিতির পরে চাকরি ছেড়ে দেন। গত দু’বছরে দেশটিতে শূন্য পদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যায়। গতবছরই প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষক পেশা ছাড়েন। ফলে গণিত, রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভাষা ইত্যাদি বিষয়ে পাঠদান অব্যাহত রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে নয়টি দেশ থেকে শিক্ষক নেয়ার ঘোষণা দেয় ব্রিটেন। ওই নয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ না থাকলেও প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে চার-পাঁচ হাজার শিক্ষক নেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। তাদের জন্য কর্মজীবনের শুরুতেই প্রায় দশ লাখ ভারতীয় রুপি ও প্রতিমাসে প্রায় আড়াই লাখ ভারতীয় রুপি বেতন নির্ধারণ করা হয়। ভারত ছাড়াও এশিয়ার মধ্যে হংকং, সিঙ্গাপুর, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইউক্রেন এবং আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে নাইজেরিয়া, ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকা, জিম্বাবুয়ে ও জ্যমাইকা থেকে শিক্ষক নেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। কিন্তু কঠিন মনোনয়ন প্রক্রিয়া ও পর্যাপ্ত যোগ্য প্রার্থীর অভাবে যুক্তরাজ্য তাদের স্কুল শিক্ষক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। শিক্ষকদের কঠিন প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং প্রাথমিক ক্যারিয়ার ফ্রেমওয়ার্ক কর্মসূচির আওতায় অন্তত দু‘বছর সময় কাটাতে হয় শ্রেণিকক্ষের পাঠদানে।
মূলত প্রয়োজনও তাই। কারণ হচ্ছে একজন গ্র্যাজুয়েটকে প্রশিক্ষণ ছাড়া হঠাৎ করে গাড়িচালকের সিটে বসিয়ে দিলে দুর্ঘটনা যে অবশ্যম্ভাবী তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই বার বার প্রশিক্ষণ দিয়ে, হাতপাকা করে এবং বৈধ লাইসেন্স নিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালাতে নামতে হয়। একইভাবে, যেকোনো বাহিনীর লোকদের কাছে আমরা যে আর্মস দেখতে পাই, সেটি ভালোভাবে চালনার জন্য তাদের দীর্ঘ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়। প্রশিক্ষণের পরে আবারও ট্রায়াল দিতে হয়, শিক্ষানবীশ হিসেবে থাকতে হয়। এভাবে যেকোনো পেশায় প্রবেশের পূর্বে শিক্ষানবীশ সময় কাটাতে হয়। একজন ভালো প্রফেশনালের কাছে শিক্ষারত অবস্থায় থাকতে হয়। একজন ডাক্তারকে পাস করার পরেও ’ইন্টার্নশিপ হিসেবে কাজ করতে হয়। শিক্ষকতা পেশায় এ ধরনের ব্যবস্থা আমাদের দেশে বিদ্যমান নেই। একজন শিক্ষার্থীকে সরাসরি আমরা ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দেই। যার শ্রেণিকক্ষ ব্যবস্থাপনা, চাইল্ড সাইকোলজি কিংবা শিক্ষা ব্যবস্থাপনা কোনো বিষয়েই কোনো জ্ঞান নেই। গত কয়েক বছর যাবত আমাদের দেশেও ধীরে ধীরে চালু হচ্ছে পেশাগত উপায়ে শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি। আগের মতো হঠাৎ করে একজন শেণি শিক্ষক হওয়ার অবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। এটি শিক্ষার জন্য মঙ্গলজনক। শিক্ষকতা পেশাটি হাতগোনা দুয়েকটি দেশ ছাড়া বিশ্বের কোথাও খুব ভালো অবস্থানে নেই। শুধু শিক্ষক সংকট নয়, শিক্ষার সংকটি বিশ্বের সর্বত্র বিরাজমান। শিক্ষায় যদি সংকট না থাকতো তাহলে বিশ্বের যে এতো সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট চলছে সেগুলো এত তীব্র আকার ধারণ করতো না। বিশ্বের তাবৎ সংকটের পেছনে তথাকথিত শিক্ষিত মানুষরাই দায়ী। মানুষ মানুষের অধিকার হরণ করছে, অন্যের অধিকারে নাক গলাচ্ছে, অন্যের জমি ও সীমানা দখল করছে, অন্যের আভ্যন্তরীণ ও গোপন বিষয়ে নিজেদের স্বার্থে হস্তক্ষেপ করছে, প্রতিবেশীকে কষ্ট দিচ্ছে। যারা এগুলো মূল হোতা তারা সবাই তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত। তাই আমরা বলতে পারি, প্রকৃত শিক্ষা সম্ভবত কোথাও দেয়া হয় না। যদি হতো তাহলে এ বিশ্বে প্রকৃতি যেভাবে সৃষ্টি করেছে এবং মানুষকে যেভাবে জ্ঞান ও বুদ্ধি দান করেছে তাতে গোটা পৃথিবীই একটি স্বর্গে পরিণত হয়ে যাওয়ার কথা। প্রকৃতি এক দেশে মাটির নিচে, কোনো কোনো দেশে মাটির ওপর সম্পদ দিয়েছে। কোনো কোনো দেশে মানুষের মস্তিষ্কের ভেতর বেশি বুদ্ধি দিয়েছে যাতে সবাই সবার কাছে নির্ভরশীল থাকে। সবকিছু সবার মধ্যে সঠিকভাবে বণ্টিত হয়। কিন্তু আমরা এর ধারে কাছেও যাচ্ছি না। নিজেদের যা আছে তা নিয়ে সন্তষ্ট নয় বরং অন্যেরটা নেয়ার জন্য কোটি কোটি ডলার খরচ করি অস্ত্র আর সেনাবাহিনী পুষতে। এভাবে মানুষ মানুষকে নারকীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে। একদেশ আরেক দেশকে শাস্তির পর শাস্তি দিচ্ছে, এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে, গোটা পৃথিবীইতেই চলছে ‘জোর যার, মুল্লুক তার’ থিউরি। তাহলে শিক্ষাটা কোথায় গেল? ব্যক্তি পর্যায়ে, প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও নৈতিকতা, সততা ও মানবতা শেখানোর চেষ্টা করা হয় কিন্তু সম্পূর্ণ জাতিগতভাবে সম্ভবত কোথাও শেখানো হচ্ছে না। তবে, শিক্ষক সমাজ পৃথিবীর সর্বএই একটি আলাদা সমাজ। একটি আলাদ এনটিটি, যা সব পেশা থেকে আলাদা। আর তাই বোধ হয় বিশ্বের সবদেশেই তারা অবহেলিত বেশি, তারাই বঞ্চিত। এর পেছনে কোনো যুক্তিই নেই। কারণ, মানুষকে কোনো দেশ প্রকৃত শিক্ষা দেয়নি। শিক্ষা সর্বত্রই অবহেলিত। ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ কবি ম্যাথিউ আরনল্ড তার ‘ডোভার বিচ’কবিতায় বলেছেন মানষের মানবতা আর নৈতিকতা ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যাচ্ছে যেমন ডোভার নদীর ঢেউগুলো ধীরে ধীরে পাথরের নুড়িগুলোকে আলগা করছে এবং নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। তারপরেই বলেছেন, ‘আমরা সবাই অন্ধকার এক সমতলে একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছি, অস্ত্র চালনা করছি অজ্ঞ সৈনিকের মতো, কারণ সৈনিকেরা জানেন না কেন তারা এ যুদ্ধ করছে। শুধুমাত্র দুয়েকজন স্বৈরশাসকের নিজের অহমিকা ও আমিত্ব জাহির করা ছাড়া এসব সংঘাতের, এসব যুদ্ধের পেছনে জোরালো কোনো যুক্তি নেই।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ টিম, দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা