বেশ কয়েক বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে হা-হুতাশ চলছে। আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মানে অবনমন ঘটেছে এটাই হতাশার একমাত্র কারণ নয়; জাতির জ্ঞানের বাতিঘর ও মানুষ বানানোর কারখানা ভাবা হয় বিশ্ববিদ্যালয়কে। সেই বাতিঘর কিংবা মানুষ বানানোর কারখানা শুধু অনুজ্জ্বল নয়, ক্রমেই যেন অন্ধকারের দিকে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় মানে চিন্তার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার পরিসর এবং বিশ্লেষণের বিস্তার। বিশ্ববিদ্যালয় মানে নানাজনের ভাবনা, মত, পথ নিয়ে নিরীক্ষা হবে, তর্ক হবে। তা থেকে সমাজ, রাষ্ট্র পাবে তার অভীষ্ট গন্তব্যে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা। জ্যাক ডেলরের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন ইউনেসকোর কাছে ‘লার্নিং দ্য ট্রেজার উইদিন’ (Learning the Treasure Within) শিরোনামে যে প্রতিবেদন পেশ করে তাতে শিক্ষার চারটি মূলস্তম্ভের (four pillar of education) কথা বলা হয়েছে—এক. জানার জন্য শিক্ষা, দুই. কর্মের জন্য শিক্ষা, তিন. একত্রে বসবাসের শিক্ষা ও চার. মানুষ হওয়ার শিক্ষা। একত্রে বসবাস ও মানুষ হওয়ার শিক্ষার জন্য অন্যতম বড় উপকরণ হলো সহিষ্ণুতা। সাম্য, সুন্দর ও সহনশীলতার চর্চা। বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায় বৈষম্য, বিদ্বেষ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে শিক্ষা। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেকে পরিশুদ্ধ করার অনুশীলনও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয় তার ঐতিহ্যগত উদার সমুদ্র থেকে সংকীর্ণ কুয়োয় পরিণত হওয়ার দিকে ছুটে চলেছে। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বৈরশাসনে রূপান্তরের একটি প্রবণতা ক্রমেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক মত প্রকাশের স্বাধীনতা বামন হতে চলেছে। সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বিকভাবে মননশীলতার অবনমন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন বিভাগের প্রধান ১৪ শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন। এর এক দিন পর ২৭ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (হাবিপ্রবি) লুঙ্গি পরে অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী তিন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এটি শিক্ষকের মননশীলতার অবনমনের প্রতিনিধিত্বকারী ঘটনা। শিক্ষকদের একাংশ এখন একে অন্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কুৎসা রটনা করছে, মিথ্যাচার ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণায় লিপ্ত হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরও এ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, শিক্ষার্থী, বিশেষ করে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভয়ংকর কুৎসা রটনা ও পরিকল্পিত মিথ্যাচার করছেন। শিক্ষকের আপত্তিকর ছবি পোস্ট করে নানা অশালীন-অশ্লীল মন্তব্য করছেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো এসব কাজে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরাও সম্পৃক্ত হচ্ছেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জানালেন তাঁর নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে ওই বিভাগের একজন নারী শিক্ষক সম্পর্কে এতটাই আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন, যা এ লেখায় প্রকাশযোগ্য নয়। আরেকটি ঘটনায় জানা যায়, জুনিয়র নারী শিক্ষার্থী ফেসবুক পেজে অ্যাডাল্ট কনটেন্ট শেয়ার করে সিনিয়রদের রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন। একটি ঘটনা এ রকম যে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগকে না জানিয়ে বিভাগের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং অত্যন্ত খারাপ পারফরম্যান্সের মাধ্যমে বিভাগের সুনাম ও ইমেজকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। এ অবস্থায় বিভাগের সব শিক্ষক মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে কোনো প্রতিযোগিতায় বিভাগের নাম ব্যবহার করে প্রতিনিধিত্ব করতে হলে বিভাগের অনুমোদন নিতে হবে। নোটিশের মাধ্যমে এটি প্রচার করার সঙ্গে সঙ্গে নোটিশে স্বাক্ষরকারী শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আক্রমণ করা শুরু হলো; এমনকি বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েও শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন তোলা শুরু করলেন। শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালি দেওয়া কিংবা তাঁর ‘প্যান্ট খুলে ফেলার’ মতো মন্তব্য পোস্ট করছেন। আবার কেউ কেউ ডাহা মিথ্যাচার করছেন—অমুক শিক্ষক আমাকে ফার্স্ট ক্লাস দেননি কিংবা আমাকে বহিষ্কার করেছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো একজন শিক্ষক প্রশ্ন প্রণয়ন করেন না কিংবা একজন পরীক্ষক নম্বর দেন না। প্রতিটি উত্তরপত্র দুজন শিক্ষক, ক্ষেত্র বিশেষে তিনজন শিক্ষক পৃথকভাবে মূল্যায়ন করেন। পরীক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উত্তরপত্রে নম্বর দেন না। তাঁরা মুদ্রিত নম্বরপত্রে নম্বর দিয়ে থাকেন। একজন পরীক্ষকের মূল্যায়নের পর একই উত্তরপত্র দ্বিতীয় পরীক্ষকের কাছে পাঠানো হয়। তিনিও মুদ্রিত নম্বরপত্রে নম্বর প্রদান করেন। উভয় পরীক্ষক মুদ্রিত নম্বরপত্র সিলগালা করে পরীক্ষা কমিটির সভাপতির কাছে এবং একই সঙ্গে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে পাঠিয়ে দেন। সব পরীক্ষকের নম্বর পাওয়ার পর পরীক্ষা কমিটি সব সদস্যের উপস্থিতিতে সিলগালাকৃত নম্বরপত্র খুলে দুই পরীক্ষক কর্তৃক প্রদত্ত নম্বরের গড় করে ফল তৈরি করেন। যদি নম্বরের ব্যবধান ১৫ শতাংশের বেশি হয় (কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০ শতাংশ) তবে উত্তরপত্রটি তৃতীয় পরীক্ষকের কাছে মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়। তৃতীয় পরীক্ষক যে নম্বর দেবেন তার সঙ্গে আগের দুজন পরীক্ষকের মধ্যে যাঁর নম্বর কাছাকাছি তাঁর প্রদত্ত নম্বরের গড় করে সংশ্লিষ্ট পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত চূড়ান্ত নম্বর নির্ধারণ করা হয়। মৌখিক পরীক্ষার ক্ষেত্রেও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন বহিঃপরীক্ষকসহ চার-পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট পরীক্ষা কমিটি মৌখিক পরীক্ষা পরিচালনা করেন। কোনো শিক্ষকের একার পক্ষে কাউকে ফার্স্ট ক্লাস দেওয়া বা না দেওয়ার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক কারণে কিংবা পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের জন্য কাউকে বহিষ্কারের ক্ষমতা কোনো একক শিক্ষকের নেই। কারণ কোনো শিক্ষার্থীকে বহিষ্কারের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, প্রক্টর, সব ডিন, একাডেমিক কাউন্সিলের প্রতিনিধিসহ ১৫-২০ জনের সংশ্লিষ্টতা থাকে। কোনো শিক্ষার্থীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে বিধি অনুযায়ী তাঁকে কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান করা হয় এবং তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। পর্যাপ্তসংখ্যক ক্লাসে উপস্থিতি না থাকলে পরীক্ষার সুযোগদানের বিষয়ে কোনো শিক্ষকের এককভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। বিভাগের সব শিক্ষক মিলে একাডেমিক কমিটিতে যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তার বাইরে কোনো শিক্ষকের এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এর পরও কোনো শিক্ষকের সিদ্ধান্তে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন পর্ষদে অভিযোগ দায়েরের সুযোগ রয়েছে। তাতেও সন্তুষ্ট না হলে আইন-আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ফেসবুকে আদালত বসানো অনৈতিক নয়, রীতিমতো অপরাধ।
kalerkanthoআমি যেসব ঘটনা উল্লেখ করেছি তা অসংখ্য ঘটনার কয়েকটি মাত্র। কেউ হয়তো বলবেন এর সঙ্গে দু-একজন শিক্ষার্থী জড়িত কিংবা এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটি সঠিক নয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষকের বিরুদ্ধে ভয়ংকর কুৎসা রটনা, পরিকল্পিত মিথ্যাচার, শিক্ষকের আপত্তিকর ছবি পোস্ট করা এবং নানা অশালীন-অশ্লীল মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিরল; বরং লাইক-কমেন্টে শত শত বিদ্যমান কিংবা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছেন; এমনকি সরকারি চাকরি করছেন এমন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরাও পিছিয়ে নেই। নারী শিক্ষকের ফিগার নিয়ে অশ্লীলতার বিরুদ্ধে ওই বিভাগের একজন শিক্ষক উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, প্রক্টর ও শিক্ষক সমিতির কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্য—সবার নির্লিপ্ততায় ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি নিজেই প্রতিকারের উপায় খুঁজে বের করেন। অশ্লীলতা ছড়ানো সাবেক শিক্ষার্থীরা যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ওই শিক্ষক সেই প্রতিষ্ঠানের নিয়োগকর্তার কাছে পোস্টের স্ক্রিনশট জমা দিয়ে প্রতিকার চাইলে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা ও গবেষণার মানে নয়, মননের দিক থেকেও ভীষণভাবে পশ্চাদমুখী হয়ে পড়ছে। শিক্ষা ও গবেষণার ঘাটতি হয়তো নতুন পরিকল্পনা করে পোষানো যাবে; কিন্তু শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মননের অবনমনে যে প্রলয় ঘটেছে তার উদ্ধার হবে কী দিয়ে? যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অশ্লীল, কুরুচিকর মন্তব্য, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল, বানোয়াট কিংবা মিথ্যা তথ্য প্রকাশ ও সম্মানহানিকর মন্তব্য প্রকাশের ঘটনায় জড়িত তাঁদের ব্যক্তিগত রুচিবোধ ও নিজের পরিবারের শিক্ষাকেও প্রশ্নের সম্মুখীন করছে। সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং নৈতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা কোনো ভদ্র পরিবারের সন্তান ফেসবুকে অপরের সম্মানহানি করতে পারে—এটি বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। তার মানে ব্যতিক্রম বাদ দিলে ওই সব পরিবারের সদস্যদের মননশীলতায়ও মারাত্মক অসুখ বাসা বেঁধেছে। প্রাসঙ্গিকভাবে দুটি আরবি প্রবাদ উল্লেখ করছি, ‘শুধু জ্ঞান তোমার কোনো কাজ দেবে না, যদি না তুমি চরিত্রের মুকুট মাথায় পরিধান করো।’ অরেকটি প্রবাদে বলা হয়েছে, ‘অস্ত্রের আঘাত শুকিয়ে যায়; কিন্তু কথার আঘাত শুকায় না।’ বিশ্ববিদ্যালয় মননশীলতায় পিছিয়ে পড়া মানে একটি জাতি পশ্চাদমুখী হয়ে পড়া। মননশীলতায় পিছিয়ে পড়া একটি জাতি টেকসই উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে বেশি দূর যেতে পারবে কি?
লেখক : মো. জাকির হোসেন, অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়