শেখ রাসেলের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

সন্তোষ দাস |

মাত্র দশ পেরিয়ে এগারোতে পা দেওয়া নিষ্পাপ ফুলের মত একটি শিশু, কি অন্যায় করেছিল? এরকম একটি শিশুর বুকে গুলি চালাতে ঘাতকদের হাত একটু কাঁপল না! এ কেমন বর্বরতা!  ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে শিশুটি বলছে। ঘাতকরা বলল, ‘চল তোরে তোর মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।’  কিন্তু মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঘাতকরা সেদিন ছোট্ট শিশুটির বুকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়েছিল। কত নির্মম, কত নিষ্ঠুর হলে এমন জঘন্য কাজ করা যায়! বিশ্ববিবেক সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। যে শিশুটির কথা বলছি, সে হলো হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির  জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট, পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বড় দুই ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল এবং দুই ভাবিসহ অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের সাথে নির্মমভাবে শিশু শেখ রাসেলকে হত্যা করে ঐ পাষণ্ড খুনিরা। ফুলের মত নিষ্পাপ যে শিশুটি রাজনীতির কিছুই বুঝত না, পার্থিব কোন কুটিলতা তখনো যাকে স্পর্শ করেনি, তাকেও এমন নিষ্ঠুর নির্মমতার শিকার হতে হলো! পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এই ঘটনা নজিরবিহীন।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ঢাকার ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সর্বকনিষ্ঠ। অন্যরা হলেন যথাক্রমে শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী), শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রেহানা। ইউনির্ভাসিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়তেন শেখ রাসেল । মৃত্যুকালে তিনি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। রাসেল নামটি বঙ্গবন্ধু নিজে রেখেছিলেন। পৃথিবীখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক, সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সাথে মিল রেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর আদরের ছোট ছেলের নাম রাখেন শেখ রাসেল। রাসেল ছিলেন সবার আদরের। রাসেল সম্পর্কে শেখ হাসিনা তাঁর নিজের লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’  বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন,

‘রাসেল আমাদের সবার বড় আদরের; সবার ছোট বলে ওর আদরের কোন সীমা নেই। ও যদি কখনও একটু ব্যথা পায়, সে ব্যথা যেন আমাদের সবারই লাগে। আমরা সব ভাই-বোন সবসময় চোখে চোখে রাখি, ওর গায়ে এতটুকু আঁচড়ও যেন না লাগে। কী সুন্দর তুলতুলে একটা শিশু। দেখলেই মনে হয় গালটা টিপে আদর করি।’

রাসেলের জন্মের সমসাময়িক দিনগুলিতে বঙ্গবন্ধুকে কখনো রাজনীতির কাজে বাইরে থাকতে হয়েছে, আবার কখনো স্বৈরশাসকদের প্রতিহিংসার শিকার হয়ে জেলে থাকতে হয়েছে। তাই শৈশবের দিনগুলিতে রাসেলকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে। এমনকি তার জন্মের দিনটিতেও বঙ্গবন্ধু বাড়িতে থাকতে পারেননি। কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁকে জনগণের মাঝে ছুটে যেতে হয়েছিল। সেদিন তিনি নির্বাচনি জনসভায় যোগ দিতে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন।

যে সময়টি ছোট্ট রাসেল একটু একটু করে বড় হচ্ছিলেন, তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গন ছিল উত্তাল আর পাকিন্তানি শাসকরা প্রায়ই বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় রেখে দিত। তাই আদরের ছোট পুত্রকে তিনি সময় দিতে পারতেন না। পরিবারের বড়দের সাথে শিশু রাসেল মাঝে মাঝে জেলখানায় যেতেন বাবাকে দেখতে। ‘কারাগারের রোজনামচায়’  বঙ্গবন্ধু শেখ রাসেলকে নিয়ে লিখেছেন,

‘৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বাড়ি চলো।’কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ওতো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমিতো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলে-মেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।’ খুব কষ্ট নিয়েই বঙ্গবন্ধু ঐ কথাগুলি লিখেছেন।

শেখ রাসেল ছিলেন ভীষণ দুরন্ত। তার দুরন্তপনার সঙ্গী ছিল একটি বাইসাইকেল। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রটোকল ছাড়াই সাইকেলে করে স্কুলে যেতেন। পাড়ার আর দশটি ছেলের মতই সাধারণ ছিল তাঁর জীবন। প্রতি বিকেলেই তিনি তার সঙ্গী সাইকেল নিয়ে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে চক্কর দিতেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভোরে প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি নিষ্পাপ ছোট রাসেলের বুকে গুলি চালাতে পাষণ্ডদের এতটুকু হাত কাঁপেনি! সেই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন ব্যক্তিগত কর্মচারি এএফএম মহিতুল ইসলামের কথায়,

‘রাসেল দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরে। আমাকে বললো, ভাইয়া আমাকে মারবে নাতো? ওর সে কণ্ঠ শুনে আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এক ঘাতক এসে আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে ভীষণ মারলো। আমাকে মারতে দেখে রাসেল আমাকে ছেড়ে দিল। ও (শেখ রাসেল) কান্নাকাটি করছিল যে ‘আমি মায়ের কাছে যাব, আমি মায়ের কাছে যাব।’ এক ঘাতক এসে বলল,‘চল তোরে মায়ের কাছে দিয়ে আসি।’ বিশ্বাস করতে পারিনি যে ঘাতকরা এতো নির্মমভাবে ছোট্ট সে শিশুটাকেও হত্যা করবে। রাসেলকে ভিতরে নিয়ে গেল এবং তারপর ব্রাশ ফায়ার।’

ঘাতকরা রাসেলকে যখন তার মায়ের কাছে নিয়ে যায়, তখন তিনি আর বেঁচে নেই। ঘাতকরা আগেই রাসেলের মা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবকে হত্যা করে। মায়ের লাশ দেখে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে রাসেল মিনতি করে বলেছিলেন,‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও।’ কিন্তু এই ছোট্ট শিশুর আকুতিতে ঘাতকদের পাষাণ হৃদয় গলেনি। মা, বাবা, বড় দুই ভাই, দুই ভাবী, চাচা প্রমুখ আপনজনদের লাশের পাশ দিয়ে যখন ঘাতকরা রাসেলকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন ঐ ছোট্ট শিশুর বুকের মধ্যে কত ব্যথা গুমরে উঠেছিল, তা  ঘাতকদের পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব ছিল না। সেটা সম্ভব হলে এমন জঘন্য কাজ তারা করতে পারত না। সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে নির্মম পৈচাশিকতায় ঐ ছোট্ট শিশুটির হৃদয় চিরতরে স্তব্ধ করে দিয়েছিল।

ঘাতকরা কেন সেদিন ছোট্ট এই শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল? কেনইবা ঘাতকরা সেদিন পরিবারের নিরপরাধ সদস্যদের হত্যা করেছিল? কারণ তারা ভয় পেয়েছিল। তারা ভেবেছিল, এই শিশুকে বাঁচিয়ে রাখলে ভবিষ্যতে সেও বঙ্গবন্ধুর মত বড় নেতা হবে। দেশের শাসনভার গ্রহণ করবে এবং সে তার আপনজনদের হত্যার বিচার করবে। কারণ তার ধমনিতেও বঙ্গবন্ধুর রক্ত প্রবাহিত। সে ঘাতকদের কাউকে ছাড়বে না। তাই তারা সেদিন ইতিহাসের এমন জঘন্যতম নারকীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল। তারা চেয়েছিল ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর নাম যেন কেউ নিতে না পারে। তাঁর সব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে চেয়েছিল। বাঙালি জাতির সৌভাগ্য শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা সেদিন ঐ বাড়িতে ছিলেন না, তাই তারা প্রাণে বেঁচে যান। না হলে তারা যা চেয়েছিল, তাই হতো। কিন্তু ঘাতকদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। রাসেল বেঁচে আছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। খুনি ঘাতকদের বিচার হয়েছে এই বাংলার মাটিতে। রাসেলের নামে গড়ে উঠেছে অনেক সংগঠন, তৈরি হয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্র, শেখ রাসেল জাতীয় শিশু-কিশোর পরিষদসহ প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা হয়েছে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব। কবি, সাহিত্যিক, লেখকরা তাঁকে নিয়ে লিখেছেন অনেক গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ এবং এখনো লিখে চলেছেন। বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘শিশুরক্ত’ নামে একটি মর্মস্পর্শী কবিতা লিখেছেন রাসেলকে নিয়ে।

                ‘তুইতো গল্পের বই, খেলনা নিয়ে

                 সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি!

                 তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো

                 শিশু রক্ত পানে তার গ্লানি নেই?

                 সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে!

                 যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায়

                 আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’

এমনিভাবে সাহিত্য ও বিভিন্ন সৃষ্টির মধ্যে শেখ রাসেল বেঁচে থাকবেন। শেখ রাসেল আমাদের অনুপ্রেরণা। জন্মদিনে তার নিষ্পাপ মুখটি স্মরণ করে আমাদের প্রতিজ্ঞা হোক দুর্নীতিমুক্ত, ষড়যন্ত্রকারীমুক্ত ও ঘাতকমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার।          

লেখক: প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026149749755859