শ্রী চিন্ময় : বিশ্ব শান্তির দূত

ভূপর্যটক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল |

১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জুলাই সিঙ্গাপুর থেকে বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণ শুরু করেন বাংলাদেশের বিখ্যাত সাইক্লিস্ট রামনাথ বিশ্বাস। ঠিক তার পরের মাসে আগস্টেও ২৭ তারিখে চট্রগ্রামের বোয়ালখালী থানার শাকপুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শ্রী চিন্ময় কুমার ঘোষ। যিনি শ্রী চিন্ময় নামেই অধিক পরিচিত। 

শ্রী চিন্ময়ের ডাক নাম মাদল। পিতৃদেব শশীকুমার ছিলেন সেকালের আসাম-বেঙ্গল রেলওয়ের ইনসপেক্টর, মা যোগমায়া ঘোষ। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে বাবা-মা’র মৃত্যুর পর সাত ভাই বোনের সবাই দক্ষিণ ভারতের পণ্ডিচেরিতে শ্রী অরবিন্দের আশ্রমে চলে যান। ভাই-বোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। পরবর্তী ২০ বছর তিনি ধ্যান, সেবা, খেলাধুলার কঠোর শিক্ষার মধ্য দিয়ে আশ্রমে বড় হয়ে উঠেন। শ্রী চিন্ময় ছিলেন একজন আধ্যাত্নিক শিক্ষক, কবি শিল্পী, গায়ক এবং ক্রীড়াবিদ।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে অন্তরের ডাকে শুধু পশ্চিমে যাত্রা করে অচেনা নিউইয়র্কে চলে আসেন এবং ভারতীয় কনস্যুলেট অফিসে তিন বছর চাকরি করেন। ধীরে ধীরে তিনি বহুমুখী প্রতিভায় কীর্তিমান হয়ে উঠেন। একজন লেখক হিসেবে ১৬০০টি বই লিখেছেন। একজন সংগীতজ্ঞ হিসেবে ২১ হাজার গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন যার বেশির ভাগই তার মাতৃভাষা বাংলায় লেখা। তিনি ভালো বাগ্মীও ছিলেন। বিশ্বের প্রধান সব বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছেন। শ্রী চিন্ময়ের গান ও কবিতা প্রেরণাদয়ক। তার রচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষা-শান্তির বাণী বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার এক ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। তার গানে তিনি মানুষের নানা দিক তুলে ধরেছেন। শ্রী চিন্ময়ের ছাত্র-ছাত্রীরা এ পর্যন্ত ৭০টি দেশে বাংলা গানের কনসার্ট করেছেন। এসব অবাঙালি গায়েন ৪০ বছর ধরে চমৎকার সুরে বাংলা গান চর্চা করেছেন। তাদের মাধ্যমে বাংলা গান ও ভাষার নিজস্ব স্বাতন্ত্র ও মাধুর্য সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি একজন শিল্পীও ছিলেন। তার আকা ঝর্নাকলা নামের চিত্রগুলোর প্রদশর্নী হয়েছে প্যারিসের ল্যুভ মিউজিয়ামসহ বিভিন্ন শ্রেষ্ঠ সব হলে।   

‘আমাদের লক্ষ হচ্ছে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর এবং উজ্জ্বলতমতে পৌছানো; এবং উচ্চ থেকে উচ্চতর এবং সর্বোচ্চ পৌঁছানো। এমনকি সর্বোচ্চ পর্যায়েও আমাদের কোনো বিরতি নেই, কারণ আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই রয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা, যিনি প্রতি মুহূর্তেই তার নিজস্ব বাস্তবতাকে বিকশিত করছেন।’ (শ্রী চিন্ময়)

স্বঘোষিত শান্তির ছাত্র শ্রী চিন্ময় প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা ও পাশ্চাত্যের গতিশীলতাকে একত্রিত করে মানব জাতির মহামিলনের পথ দেখিয়েছেন। জাতিসংঘের তৃতীয় মহাসচিব উথান্টের অনুরোধে শ্রী চিন্ময় নিউইয়র্কের জাতিসংঘের মূল ভবনে সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য আমৃত্যু সাপ্তাহিক মেডিটেশন সভা পরিচালনা করে গেছেন। শ্রী চিন্ময় বলে থাকেন, ‘শান্তি মানে যুদ্ধের অনুপস্থিতি নয়। শান্তি মানে সমন্বয়, সংগতি, সামঞ্জস্য, ডালপালা, সন্তষ্টি এবং  একাত্মবোধের ঐকতান।’

১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে আমি তখন সাইকেলে বিশ্বভ্রমণরত। সে সময় আমি লন্ডনে ছিলাম। শ্রী চিন্ময় ঠিক সে সময় লন্ডনের রয়াল আ্যলবার্ট হলে সংগীত পরিবেশনের জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি ৪৩টি দেশে ৫০০ বার পিস-কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন। 

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ, মাদার তেরেসা, প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটুসহ বহু আলোকিত বিশ্ববিখ্যাত ব্যাক্তির সঙ্গে তার আন্তরিক সম্পর্ক ছিলো। পৃথিবীর ৭০টি দেশ ঘুরে ঘুরে তিনি তার ক্রীড়া সংস্কতি, ধ্যান ও মানবসেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছেন। চিন্ময় প্রাথর্না এবং ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে একটি আধ্যাত্মিক পথের পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি দূরত্ব, দৌড়, সাঁতার এবং ভারোত্তোলনসহ অ্যাথলেটিকিজমের পক্ষে ছিলেন। তিনি ম্যারাথন ও অন্যান্য দৌড়ের আয়োজন করেছিলেন। ৬০-এর দশকে শ্রী চিন্ময় ওজন (ভারোত্তোলন) তুলতে শুরু করেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে একটি বিশেষ উত্তোলন যন্ত্রে কয়েক হাজার পাউন্ডের বেশি কাঁধে চাপ দিতে পারেন। মানবিক সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে সাহায্য করার জন্য তিনি বিমান, স্কুল হাউস ও পিকআপ ট্রাকসহ ভারী বস্তু তুলেছিলেন।

তিনি হারমনি রান নামে রিলে রেসের মতো এক দৌড়ের উদ্যোগ নেন বিশ্বের ৬টি মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। যার লক্ষ্য ছিলো প্রজ্জ্বলিত শিখা হাতে শান্তির বাণী নিয়ে বিভিন্ন দেশের জাতি ধর্ম-বর্ণের মানুষের মাঝে প্রীতি ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা। তিনি ম্যারাথন দল গঠন করেন। এই দল প্রতি বছর বিভিন্ন দেশে ৫০০টিরও বেশি বিভিন্ন ধরনের দৌড়ের আয়োজন করে থাকে। যার মধ্যে রয়েছে ১০০ মিটার দৌড় থেকে বিশ্বের দীর্ঘতম ৫২ দিনে ৩ হাজার ১শ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতা। প্রতি বছর জুন-আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কুইন্সে যে দৌড় প্রতিযোগিতা হয় তা তিন হাজার একশ মাইল (৪৯৮৯ কিমি) দীর্ঘ।

শ্রী চিন্ময় ওয়াননেস হোম পিস রানের প্রতিষ্ঠাতা। তার এই শান্তি মশাল ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১০০টিরও বেশি দেশে বিভিন্ন স্কুল অতিক্রম করছে। শ্রী চিন্ময় ১৩ বার আমেরিকার সিয়াটলে যান। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইউনিভাসিটি অব ওয়াশিংটনের শিল্প অনুষদে সাম্মানিক নিয়োগ পান। ইংরেজি বিভাগ তাকে বিশ্ব শান্তি সাহিত্য পুরস্কার এবং দ্য লাইট অব এশিয়া পুরস্কার দেয়। 

শ্রী চিন্ময় শান্তির ছাত্র হিসেবে পরিচিত হতে চেয়েছেন। বিশ্বজুড়ে তার শান্তি মূর্তি স্থাপিত হয়েছে। আমেরিকার সিয়াটলে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ নভেম্বর তার ‘বিশ্ব শান্তির স্বপ্নদর্শী’ শিরোনামে ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়। সারা বিশ্বে এটি তখন পর্যন্ত তার ৭ম মূর্তি। 

২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৬-১০ জানুয়ারি বাংলাদেশেও এই ম্যারাথন দৌড় অনুষ্ঠিত হয় সোহরাওয়ার্দী  উদ্যান থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত। এই ওয়ার্ল্ড হারমনি রান বিশ্বের ১০০টির বেশি দেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে গত ২৫ বছর ধরে। এই দৌড় একটি অলাভজনক ইভেন্ট যা সম্পূর্ণরূপে শ্রী চিন্ময়ের উদ্যোগে অনুপ্রাণিত।  যে কেউ এই দৌড়ে অংশ নিতে পারেন। আমেরিকা, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের বেশ কিছু দেশের দৌড়বিদ বাংলাদেশে মশাল বহন করে ঢাকার ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে শুরু করে চট্রগ্রামের বন্দর ও পাহাড়ের জন্মস্থান শাকপুরা গ্রামে পাঁচদিন ব্যয় করবেন।   

শ্রী চিন্ময় ‘দ্য ওয়ান্নেস হার্ট টিয়ার্স অ্যান্ড স্মাইলস’ নামে আর্ত মানবতার সেবার লক্ষ্যে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। খাদ্য, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা উপকরণসহ সব শিশুর জন্য নানা ধরনের খেলনা সংগ্রহ করে বিশ্বের সামাজিক-প্রাকৃতিক দুর্যোগপূর্ণ এলাকাগুলোতে পৌঁছে দেন। 

শ্রী চিন্ময় ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ অক্টোবর মাত্র ৭৬ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে নিউইয়র্কের কুইন্সে তার বাড়িতে মারা যান। 

লেখক :  ভূপর্যটক আশরাফুজ্জামান উজ্জ্বল, প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ ট্টাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039069652557373