শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন জটিল তবে আনন্দের কাজ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শ্রেণিকক্ষে মূল্যায়ন একটি আর্ট, একটি বিশেষ ধরনের বিজ্ঞান। এতে একজন শিক্ষকের আগ্রহ থাকতে হবে। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে, প্রতিটি কাজে ও বিষয়ে একজন শিক্ষার্থীর আচরণসহ অন্যান্য পারিপাশির্^ক দিকে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে তা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করাই হচ্ছে একজন শিক্ষকের কাজ। এটি জটিল-কঠিন কিন্তু অনেক আনন্দের। যেমন আনন্দের বাগানের চারাগাছগুলোর যত্ন নেয়া এবং সেগুলোর মধ্যে প্রতিটি প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে ও মাসে কী ধরনের পরিবর্তিত হচ্ছে, কখন কীভাবে ফুল ধরছে, ফল ধরছে তা দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা যেমন আনন্দের; শ্রেণীকক্ষে শিক্ষার্থীদের সেভাবে দেখাও আনন্দের। 

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এ আনন্দ একজন শিক্ষককে বের করে নিতে হবে। বিষয়টি আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে নেই, তবে কিছু কিছু এরিয়াতে আছে সেটি তেমন কার্যকরী নয় এবং খুব আনন্দের সংবাদও নেই সেখানে। তবে পরিবর্তিত কারিকুলামে সেটিতে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে শিক্ষাক্ষেত্রে সংযোজন করা হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত শ্রেণীকক্ষের মূল্যায়নে বার্ষিক পরীক্ষার চেয়েও বেশি নম্বর রাখা হয়েছে। আর দশম শ্রেণীতেও ৫০ শতাংশ রাখা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে শিক্ষকগণ কতটা নিরপেক্ষভাবে এ মূল্যায়ন করবেন। প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন হবে এবং কোন বার্ষিক পরীক্ষা হবে না। এটি বাস্তাবায়ন করা হলে চমৎকার একটি বিষয় হবে শিশু শিক্ষার ক্ষেত্রে কারণ আমাদের শিশুদেরও পরীক্ষার্থী বানানো হয়েছে, তাদের ফেলে দেয়া হয়েছে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্যে। এতে তাদের শারীরিক, মানসিক বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে কিন্তু অভিভাবক ও সমাজ যেন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না। তাই এই বিষয়টি চালু হলে বেঁচে যাবে আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে কারা এটি বাস্তবায়ন করবেন? কীভাবে করবেন? চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ৭০ শতাংশ শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন হবে এবং বার্ষিক পরীক্ষা হবে ৩০ শতাংশ নম্বরের। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত ৬০ শতাংশ শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশে ৩০ শতাংশ শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন ও ৭০ শতাংশ পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়ন হবে। এটি একটি কার্যকরী উদ্যোগ প্রতিটি শ্রেণীতেই ফরমেটিভ অ্যাসেসমন্টে বা অবিরত মূল্যায়নের বিষয়টি গুরুত্ব পেতে যাচ্ছে। একজন শিক্ষক যিনি শ্রেণীকক্ষে তার শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন, তার হাতেই থাকতে হবে প্রকৃত মূল্যায়ন। এটির বিকল্প খুব কমই আছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে, যেভাবে এবং যে পরিস্থিতিতে আমাদের দেশে শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয় বা তারা শিক্ষকতা পেশায় আসেন সেগুলো বিবেচনায় নিলে এ ধরনের মূল্যায়ন করা কত শতাংশ শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব হবে?

সুইডিস শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রেডিং মূলত তিন প্রকার। ফেল, পাস এবং পাস উইথ ডিস্টিংশন। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এ, বি, সি, ডি এবং এফÑ এই ছয় ভাগে গ্রেডিং করা হয়। তবে বি এবং ডি গ্রেডকে বলা হয় ফিলিং গ্রেড। পরীক্ষা হয় ২০ পয়েন্টের ওপর। প্রাথমিক পর্যায়ের শিশুরা অপশনাল বিষয়সহ মোট ১৭টি বিষয়ে সর্বোচ্চ ৩৪০ নম্বর অর্জন করতে পারে। শিশুদের তৃতীয়, ষষ্ঠ এবং নবম শ্রেণীতে জাতীয়ভাবে মূল্যায়ন পরীক্ষা নেয়া হয়। সকল শিশুকে সমানভাবে মূল্যায়ন করাই এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য। তবে ষষ্ঠ শ্রেণীর আগপর্যন্ত শিশুদের গ্রেডিং করা হয় না। তৃতীয় শ্রেণীতে শুধুমাত্র গণিত ও সুইডিস ভাষার ওপর পরীক্ষা নেয়া হয়। অন্যদিকে ষষ্ঠ শ্রেণীতে গণিত সুইডিস ভাষা এবং ইংরেজির ওপর লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। পাশাপাশি নবম শ্রেণীতে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যা মধ্য থেকে যে কোন একটি এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয় থেকে একটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে হয়।

ভিন্নধর্মী অথচ বাস্তব এই মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার জন্য শিক্ষকদের প্রস্তত করতে হবে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তত করতে হবে। বহু দেশে বিষয়টি চালু আছে তবে আমরা চালু করতে বিলম্ব করে ফেলেছি। অনেক শিক্ষক এটিকে পছন্দ করছেন কিন্তু একবারে এত নম্বর শিক্ষকদের হাতে না রেখে এটিকে ধীরে ধীরে বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন। প্রধান শিক্ষকগণ বলছেন শিক্ষকদের কাছে শিক্ষার্থীরা যাতে জিম্মি না হয় সেজন্য কোচিং বন্ধ করার জন্য নীতিমালা তৈরি করা হয়েছিল। প্রাইভেট পড়লে শ্রেণীকক্ষে তার সঙ্গে ভালোভাবে শিক্ষকরা কথা বলেন, আচরণ করেন, পরীক্ষায় বেশি নম্বর পান। না পড়লে ঘটে উল্টোটা। পরীক্ষা নেয়া হলে খাতায় রেকর্ড থাকে আর শ্রেণীকক্ষে মূল্যায়ন সব সময় কাগজে-কলমে থাকবে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন কায়দার। কোথাও শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে উপচে পড়ছে, শ্রেণীকক্ষ ঠাঁই দিতে পারছে না আবার কোথাও শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। যারা শিক্ষার্থী পাচ্ছে না তারা শিক্ষার্থী ধরে রাখার জন্য এবং শিক্ষার্থী কম থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের দিকে মনোযোগ দিতে পারবে। কিন্তু যেখানে শিক্ষার্থী বেশি সেখানে শিক্ষক কীভাবে তাদের গুণাগুণ সম্পর্কে জানবে। ব্যক্তিগতভাবে না চিনলে তো তাদের মূল্যায়ন করতে পারবেন না। সেখানে সৃষ্টি হবে এক বিরাট বৈষম্য। কোন বিদ্যালয়ের লাস্টবয় যে নম্বর পাবে, প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ের কোন অলরাউন্ডার শিক্ষার্থীও তো সেই নম্বরের অনেক পেছনে থাকবে। সেখানে এক বৈষম্যের সৃষ্টি হবে, হবে না প্রকৃত মূল্যায়ন। এর আরেকটি সমস্যা হচ্ছে যেসব শিক্ষার্থী অন্তমুর্খী বা ইনট্রোভার্ট টাইপের তাদের সমস্যা হবে অনেক। কারণ তারা সৃষ্টিশীল, তবে তাদের সৃষ্টি প্রচার করার মতো বা কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তারা কোন ধরনের প্রচার বা কার্যক্রম করবে না; ফলে তারা মার খেয়ে যাবে বেশি। এখানে শিক্ষকদের বড় ভূমিকা পালন করতে হবে অর্থাৎ একজন শিক্ষকের পরিচালিত শ্রেণীকক্ষের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কারা কোন চরিত্রের সেটির দিকে বিশেষ দৃষ্টি হবে; যারা ইন্ট্রোভার্ট তাদের সৃজনশীলতাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে কারণ তারা প্রকাশ করবে না। তারা যাতে প্রকাশ করে শিক্ষককে সেই ধরনের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

কিছু শিক্ষকদের ব্যক্তিগত আক্রোশ কোন শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষার্থী মূল্যায়নে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। এ ঘটনা তো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অহরহ দেখতে পাই। তারা যদিও জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করেন অথচ ব্যক্তিগত সীমাটুকু অতিক্রম করতে পারেন না অনেকেই। প্রকৃত অর্থেই একজন মেধারী শিক্ষার্থী প্রথম বিভাগ অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হন কারণ তিনি হয়তো একজন শিক্ষকের ব্যক্তিগত চাহিদা অনুযায়ী অনেক কিছুই পূরণ করতে পারেননি, ফলে তার প্রতি শিক্ষকগণ খুশি নন; যার প্রতিফলন দেখা যায় একাডেমিক ফলাফলে। এ ধরনের ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অহরহ ঘটতে থাকে। এই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা তখন উচ্চ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকদের কী হবে? কতটা পারবেন তারা প্রকৃত মূল্যায়ন করতে? শিক্ষকদের কোচিং নিয়ে এত কথা হচ্ছে কেন? এর মাধ্যমে কিছুসংখ্যক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে রাখে। যেসব শিক্ষার্থী এসব শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়ে শিক্ষকরা তাদের সাথে ভালো আচরণ করেন, তাদের খোঁজখবর নেন- তারা সহজেই বেশি বেশি নম্বর পেয়ে যায়। ফলে এ মূল্যায়ন শিক্ষকের ব্যক্তি চিন্তার ওপর নির্ভর করবে। এগুলো হচ্ছে এ ধরনের মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করার পটেনশিয়াল বাধা।

তবে এসব কারণে শ্রেণীকক্ষের মূল্যায়নকে তো আমরা বাদ দিতে পারি না বা দেওয়া ঠিকও হবে না। কী করা যায় এজন্য? পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ মূল্যায়ন করা হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পায় তা হচ্ছে কে কতটা তথ্য মুখস্থ করতে পারছে তার এক ধরনের প্রতিযোগিতা। কিছু বিষয় শিক্ষার্থীদের আত্মস্থ করতে হয়; তার মানে এই নয় যে, পুরো একটি বিষয় কোন উৎস থেকে নিয়ে মুখস্থ করে সেটি পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দেয়া। কিন্তু এখানে দেখতে হবে শিক্ষার্থীর দৃষ্টিভঙ্গি, গুণাবলী ও মূল্যবোধ অর্জিত হয়েছে কিনা। তাই পাবলিক পরীক্ষায় সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি শ্রেণীকক্ষের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র কাগজ-কলমনির্ভর মূল্যায়ন নয়। এখানে রাখতে হবে পর্যবেক্ষণ, পোর্টফলিও, প্রতিফলনভিত্তিক ও প্রক্রিয়ানির্ভর মূল্যায়ন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, সতীর্থ মূল্যায়ন, অংশীজন মূল্যায়ন, টেকনোলজির ব্যবহার। এগুলোর যথাযথ রেকর্ড রাখতে হবে। সেজন্য প্রথমেই বলেছি বিষয়টি অত্যন্ত কঠিন; তবে আনন্দেরও যদি শিক্ষক সেই আনন্দটুকু ভোগ করতে চান।

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029709339141846