এ সম্পাদকীয় মতামতটি যখন লিখছি তখন যুক্তরাজ্যের লিডস শহরে সেপ্টেম্বরের পাঁচ শেষ হচ্ছে। প্রবাসে থেকেই দেশের গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। তার মাঝেই দেখলাম কত তরুণ অরুণ আমাদের অলক্ষ্যেই বুকে বুলেট নিয়ে অস্তাচলে চলে গেলেন, রক্ত দিয়ে বিদায় করলেন রক্তলোভী স্বৈরাচারীকে। সেই বিজয়ের এক মাস পূর্ণ হলো। আমাদের হাতে রইল হারানো আপনজনদের স্মৃতি, ভগ্নদশার সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিপদগ্রস্ত অর্থনীতি। এর মাঝে আরেক দগদগে ক্ষত রয়ে গেছে হযবরল এবং অসংগতিপূর্ণ শিক্ষাক্ষেত্রে। বিজ্ঞজনরা বলেছেন শিক্ষা ব্যবস্থার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দূরদর্শিতার অভাব এবং সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট। এ সম্পাদকীয়তে তরুণদের পক্ষ থেকেই কথা বলব—শিক্ষা ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের অসামঞ্জস্য এবং সেগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে। শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়। সম্পাদকীয়টি লিখেছেন আসিফ বায়েজিদ।
সম্পাদকীয়তে আরো জানা যায়, শিক্ষা ব্যবস্থা মেরামত শুরু করার আগে আমরা নিজেদের একবার প্রশ্ন করি, বর্তমানে শিক্ষা যে অবস্থায় আছে তা আদতেও ক্ষতিগ্রস্ত কিনা। এর জন্য খুব বেশি গভীরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। জাতীয় মূল্যায়ন ২০২২ বলছে, দেশের প্রাথমিক স্তরের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী মাতৃভাষায় কিছু পড়তে এবং বুঝতে পারে না। খুব সাধারণ যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগের অপারেশন সম্পন্ন করতে পারে না এবং এমন অবস্থা যে কেবল এ প্রজন্মের তা নয়। আপনি সরকারি চাকরিপ্রার্থীদের পড়াশোনা খেয়াল করে দেখুন, তারা অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া বা পাস করা শিক্ষার্থী।
তাহলে সমস্যা কোথায়? শিক্ষক পারছেন না? না, শিক্ষক পারছেন না। শিক্ষকের পারার কোনো ব্যবস্থাও রাখা হয়নি। আমাদের শিক্ষকদের খেয়েপরে বাঁচতে, ন্যূনতম জীবনমান রক্ষা করতেই নাভিশ্বাস! কী জন্য তারা ছাত্রদের দিকে মনোযোগ দেবেন আর কী কারণেই পেশাগত উন্নয়নে আগ্রহী হবেন? এ দুরবস্থার কারণে মেধাবী তরুণরা ধীরে ধীরে শিক্ষকতায় আসার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন—এ পেশা হয়ে উঠছে মেধাশূন্য এবং নিরুপায়। স্কুল পারছে না? না, পারছে না। শিক্ষার যা বাজেট, তা অপ্রতুল। যেটুকু বরাদ্দ হয় তার খুব অল্পই স্কুলের কল্যাণের জন্য ব্যবহৃত হয়। মন্ত্রণালয় পারছে না? না। একই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য দুটি মন্ত্রণালয় (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা) এবং আরো কিছু সমন্বয়হীন সরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে এমন একটি ভজঘট অবস্থা, যা কীভাবে সমাধান হবে তা কেউ জানে না! শিক্ষানীতি পারছে না? একদমই না। ২০১০-এ করা বাংলাদেশের শিক্ষানীতি একটি অপরিপক্ব, অদূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং গবেষণালব্ধ তথ্য ছাড়াই রচিত একটি অস্বচ্ছ খসড়া। যেটি অনুসরণ করা দূর, যেটি জাতীয় পর্যায়ে আলোচনার বাইরেই চলে গেছে। শিক্ষা নিয়ে বহু এলোপাতাড়ি উদ্যোগ নেয়া হলেও শিক্ষানীতিটিকে উদ্যোগগুলোর রেফারেন্স হিসেবে প্রকৃতপক্ষে ব্যবহার করার উদাহরণ বিরল।
এখন আসুন, একটু প্রশ্ন করি, কেন এসব মহার্ঘ্য উদ্যোগ ব্যর্থ হলো? শিক্ষা নিয়ে সব উদ্যোগ কি জনকল্যাণমূলক (meant for public good) ছিল না? সোজাভাবে দেখতে গেলে উত্তর পাব—না। অন্তত গত ১৬ বছর দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে জনকল্যাণমূলক কোনো ফলাফল দৃষ্টিগোচর হয়নি। একের পর এক আকস্মিক পরিবর্তন এবং অবিবেচক সিদ্ধান্ত শিক্ষার্থীদের করেছে ল্যাবের গিনিপিগ, অভিভাবকদের করেছে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য এবং দেশকে করেছে মেধাশূন্য। কেন? ইচ্ছা ছিল না? সক্ষমতা ছিল না? গণমাধ্যম (কারণ আমদের যথেষ্ট স্বচ্ছ গবেষণা নেই, তাই খবরের কাগজের ওপরই নির্ভরশীল) পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দ্বিতীয়টি থাকলেও প্রথমটি একেবারেই অনুপস্থিত। দেখুন, যার মূল্য আপনার কাছে বেশি, আপনি তার যত্ন করবেন—এ-ই তো স্বাভাবিক, নয় কি? প্রথমত, বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়নি—প্রমাণ পাওয়া যায় বাজেটেই। শিক্ষায় ১ দশমিক ২ শতাংশ বরাদ্দ দিয়ে এত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর চাহিদা নিরূপণের সিদ্ধান্ত নিছক অনিচ্ছা এবং অবহেলা ছাড়া আর কী? যেটুকুও বরাদ্দ, তার মাঝে দুর্নীতি, অনিয়ম, জবাবদিহিতাবিহীন স্বেচ্ছাচারিতা স্কুলগুলোয় কোনো উপকার পৌঁছাতে দেয়নি। আর সক্ষমতার প্রশ্নে, পূর্ণ সক্ষম না হলেও সক্ষমতা ছিল—তবে সদিচ্ছা মোটেই ছিল না, শিক্ষা ব্যবস্থার পূর্ণ শক্তি জনকল্যাণের কাজে ব্যবহার হয়নি। কিন্তু কেবল সদিচ্ছা ও সক্ষমতার অভাবে জনকল্যাণ হয়নি—এভাবে চিন্তা করাও ছেলেমানুষিই মনে হচ্ছে। ‘হীরক রাজার দেশে’-তে হীরকরাজ কী বলেছিলেন, মনে পড়ে? ‘এরা যত বেশি পড়ে, তত বেশি জানে, তত কম মানে!’, ‘আজ থেকে পাঠশালা বন্ধ!’ সুশিক্ষা উন্নত বিবেকবান মানুষ তৈরি করে। কিন্তু সেই মানুষ নিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসকের বিপদ হলো, তারা বড় বেশি প্রশ্ন করে। তাদের চাই অনুগত ভৃত্য। তাই শিক্ষা ব্যবস্থাটি যদি ইচ্ছা করেই ভেঙে রাখি, কিন্তু দেখাই যে সক্ষমতার অভাবে সফল হলাম না, তাহলে সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না!
সে যাক, দুরাত্মা নিপাত গেছে। কিন্তু এ দফা রফা হওয়া শিক্ষা নিয়ে আমরা কী করব? এর মেরামত (এবং প্রয়োজনে পুনর্নির্মাণ) করার উৎকৃষ্ট সময় এখনই, অন্তত চিন্তা করার সময়। আমরা জানি, বর্তমান শিক্ষা উপদেষ্টা সুচিন্তিতভাবে তাৎক্ষণিক বিচারে অযত্নশীল কোনো উদ্যোগ গ্রহণে অনীহা দেখিয়েছেন, তিনি সাবধানী পদক্ষেপ নিতে চান। ২০২২ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখায় রচিত পাঠ্যপুস্তক তিনি বাতিল না করে কেবল অসংগতি দূর করার পক্ষপাতী। আবার যেহেতু নবম-দশম শ্রেণীর নতুন পাঠ্যপুস্তক অসম্পূর্ণ অবস্থায় রেখেই স্বৈরাচারী পালিয়েছে, তাই ঠিক পূর্ববর্তী শিক্ষাক্রমের পাঠ্যপুস্তক পুনর্মুদ্রণ করেই এ দুই শ্রেণীর পড়াশোনা অব্যাহত রাখা। সরকার যে সময় ২০২৫-এর পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে, সেই সময় আমরা একটু চিন্তা করার সুযোগ পাব, যে অদূর এবং সুদূর ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কী করলে কল্যাণ হবে।
তাহলে এখন কী করণীয়? বিভিন্ন মহল থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ এবং সুপারিশ আসছে। যেমন শিক্ষাক্রম সংস্কার করা, শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়নের জন্য তাদের বেতন বৃদ্ধি করা, পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করা ইত্যাদি। আরো কিছু জরুরি প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যেমন শিক্ষাক্রমে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো বা কোন কোন বিশেষ বিষয়বস্তু বাদ দেয়া বা মূল্যায়ন পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করা। সত্যি কথা—এ সব মিলিয়েই জনগণের কণ্ঠ। কিন্তু কোনো একটি জায়গা ফাঁকা থেকে যাচ্ছে না? আমরা সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের শিক্ষার একটি রূপরেখা দেখতে পাচ্ছি না—রোডম্যাপটি আমাদের জানা নেই। শিক্ষায় আমাদের জাতীয় দর্শন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যে দর্শনটি আছে, সেটি তো অবধারিতভাবেই ফ্যাসিবাদ প্রচার করে। কিন্তু আমরা দেশের মানুষ হিসেবে জানতে চাই আমাদের সন্তানরা এক-দুই দশক পর পড়াশোনা শেষে কোথায় যাবে, কী করবে? নভোচারী হবে নাকি সামাজিক উদ্যোক্তা হবে? উদ্ভাবক হবে নাকি বিতার্কিক হবে? নাকি কেবলই নির্মোহ অধিকারসচেতন ভালো মানুষ হবে?
দর্শনটুকু থাকলেই আমাদের কাজ শেষ নয়, সেই দর্শন প্রতিফলিত হয় এমন একটি চমৎকার শিক্ষানীতি প্রয়োজন। সেই শিক্ষানীতি নির্ধারণ করে দেবে—অনাগত প্রজন্মকে আমরা কেমন বিদ্যালয়ে পাঠাতে চাই, কেমন শিক্ষকের হাতে গড়তে চাই, কেমন পাঠ্যপুস্তক চাই ইত্যাদি। শিক্ষানীতিই আমাদের পথ দেখাবে, শিক্ষায় বিভিন্ন স্তরের বিকল্পগুলো কী কী। বলে দেবে প্রাথমিক শিক্ষা ১২ বছর পর্যন্ত হবে কিনা, বলে দেবে মাধ্যমিকে বিজ্ঞান-বাণিজ্য-মানবিক আলাদা বিভাগ হবে কিনা, বলে দেবে মাধ্যমিকের পর কেউ কারিগরি শিক্ষায় যেতে চাইলে কী করবে অথবা কেউ কারিগরি থেকে গবেষণা করতে চাইলেও কোন পথে এগোবে। সেই শিক্ষানীতির সঙ্গে সচেতন সংযোগ এবং সমন্বয় থাকবে যুব, বাণিজ্য, নারী ও শিশু, কর্মসংস্থান, কৃষি, ক্রীড়া, অর্থ, সমাজকল্যাণ, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্রসহ সব সংশ্লিষ্ট নীতিমালার। সেই শিক্ষানীতি আমাদের জাতীয় স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার পথ দেখাবে।
এবার শেষ প্রশ্ন, এমন শিক্ষাদর্শন এবং শিক্ষানীতি আমরা কোথায় কিনতে পারি? পরিতাপের বিষয়, কোনো উন্নত দেশে গিয়েও এমন শিক্ষাদর্শন, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম কিনে নিয়ে আসা সম্ভব নয় যেটি আমাদের কাজে লাগবে। নিজেদের প্রয়োজন আমাদের নিজেদেরই মেটাতে হবে এবং তার জন্য গঠন করতে হবে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি শিক্ষা কমিশন। আমরা পূর্বে উডের ডেসপ্যাচ বা কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন অথবা হামুদুজ্জামান কমিশনের গুণগান শুনেছি। আবার মনিরুজ্জামান কমিশনের অজনপ্রিয়তাও শুনেছি। সেগুলোর কোনোটিতেই ফিরে যাওয়ার সুযোগ আমাদের নেই। বস্তুত সামনে এগোনোর জন্য অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের দিকে অগ্রসর হওয়াই কাম্য হবে। আমাদের নতুন শিক্ষা কমিশন গণমানুষ এবং ঋদ্ধ পণ্ডিত, চিন্তক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, গবেষক, লেখক, শিল্পী, ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা, চাকরিদাতাসহ সব শ্রেণী-পেশার অংশীজনদের নিয়ে তৈরি হবে। তারা বর্তমান শিক্ষার্থীদের একটি ধাক্কা না দিয়ে খুব সাবধানে একটি তথ্যনির্ভর শিক্ষানীতি প্রবর্তন করবেন এবং একই সঙ্গে জানাবেন নীতিমালাটি বাস্তবায়নের পরিমাপযোগ্য উপায়। মূলত এ শিক্ষানীতিই আমাদের উদ্ভ্রান্ত হয়ে পথ খোঁজার হাত থেকে বাঁচিয়ে জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী পথনির্দেশনা দেবে।
সম্প্রতি আমরা শুনতে পেয়েছি, বিদগ্ধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের সংবিধান পুনর্লিখন করার প্রস্তাব এবং রূপরেখা দিচ্ছেন। বস্তুত সংবিধান একটি দেশের জাতীয় দর্শন এবং ব্যাপক অর্থে আইন নির্দেশ করে। বর্তমান সংবিধান ফ্যাসিস্ট শাসনামলের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে এবং এটি এখন সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে গণ্য হতে ব্যর্থ। তাই এটির পুনর্লিখন ছাড়া আমাদের হাতে আর উপায় নেই। আমাদের শিক্ষানীতিও মানুষের আকাঙ্ক্ষার অর্থে পুনর্লিখিত হওয়ার দাবি রাখে। আমরা স্বল্প সময়ের মাঝে অনেকটুকু কাজ সম্পন্ন করার কথা বলছি। আমরা চাই না আর ভৃত্য তৈরির কারখানা। চাই উদ্ভাবক, চিন্তক, গবেষক, নেতৃত্ব। কিন্তু আমি আশাবাদী, আমরা খেটেখুটে সবটুকুই ঠিক করে নিতে পারব, নিজেদের দায়বদ্ধতা নিজেরাই সৎভাবে নিবারণ করতে পারব।
লেখক : আসিফ বায়েজিদ, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রম গবেষক, যুক্তরাজ্য