কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন তার ‘নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষায় মেগা প্রকল্প’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘নতুন পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জিত হয়। শিক্ষার্থীদের শ্রেণি অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারিত আছে। ফলে একে বলা যায় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এতে এতোকালের নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী রূপান্তরিত হচ্ছে সক্রিয় শিক্ষার্থীতে।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘ইংরেজ আমলে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পর এ দেশে গত দেড় শ বছরে শিক্ষার উন্নয়নে যত চেষ্টা হয়েছে, সেগুলো ছিলো মেরামতি কাজ। কিন্তু এ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হচ্ছিলো না।’
আবুল মোমেন অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন পদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এর সবচেয়ে কম আলোচিত, অথচ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে টেনে এনেছেন। সেটি হলো নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থীকে কীভাবে সক্রিয় শিক্ষার্থীতে রূপান্তরিত করা যায়। তিনি অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখনের বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে সক্রিয় শিখন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার কথাই তুলে ধরেছেন। এজন্য তাকে ধন্যবাদ।
দীর্ঘদিনের আলোচনা-পর্যালোচনা ও তর্কবিতর্কের পর সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীগণ, সচিববৃন্দ এবং বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ অনুমোদিত হয়।
পূর্বের ন্যায় সেদিনও সক্রিয় শিখন পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। সম্ভবত অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখনকে মূল শিখন পদ্ধতি হিসেবে প্রাধান্য দেয়ার কারণেই সক্রিয় শিখনের তাত্ত্বিক ও কলাকৌশলগত দিকগুলো রূপরেখায় বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়নি।
তথাপি জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২১ এ শিখনকে অনেক বেশি কার্যক্রমভিত্তিক ও শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডেভিড কোবের চার ধাপ বিশিষ্ট চক্রের নাম দেওয়া হয়েছে বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাভিত্তিক সক্রিয় শিখন।
এখানে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রাক প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিখন শেখানো কৌশল হবে প্রধানত খেলা ও কাজ ভিত্তিক এবং অনুসন্ধানমূলক। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন খেলা ও কাজের মাধ্যমে সক্রিয়ভাবে শিখনে অংশগ্রহণ করবে এবং আনন্দের সঙ্গে জ্ঞান, দক্ষতা মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি ও চেতনার উন্নয়ন ঘটাবে।
আরো বলা হয়েছে, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির শিখন শেখানো কৌশল এর পরিসর হবে আরো একটু বৃহত্তর ও সমন্বিত। শিক্ষার্থীদের শিখনে খেলা ও হাতে-কলমে কাজের পাশাপাশি অনুসন্ধানমূলক শিখন ও সমস্যা সমাধানমূলক শিখনকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হবে।
আমরা জানি, শিক্ষক কেন্দ্রিক শিখন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের কেবল বক্তৃতা শুনতে হয়। সেখানে শ্রেণি কার্যক্রম হয়ে পড়ে একমুখী এবং শিক্ষার্থীরা শুধু নিষ্ক্রিয়ভাবে পাঠ গ্রহণ করে থাকে। পাওলো ফ্রেইরি এটিকে ব্যাংকিং পদ্ধতির শিখন আখ্যা দিয়েছেন।
ব্যাংকে যেমন আমরা টাকা জমা রাখি ও উঠাই, এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীরাও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের নিকট থেকে জ্ঞান মস্তিষ্কে জমা রাখে এবং পরীক্ষার সময় সেখান থেকে জ্ঞান বের করে উত্তর লিখে দিয়ে আসে। স্বাভাবিকভাবেই এটি অন্ধভাবে বিষয়বস্তু মুখস্থ করার দিকে শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করে।
নিষ্ক্রিয় ও অন্ধ মুখস্থবিদ্যার শিক্ষা বাস্তব জীবনে কাজে লাগে না। সেজন্য ফ্রেইরি ১৯৭০ দশকে সক্রিয় শিখন পদ্ধতির গুরুত্ব তুলে ধরেন। তার পূর্বসূরী জন ডিউই, মারিয়া মন্তেসরী, জ্যা পেঁয়াজি, লেভ ভিগটস্কি প্রমুখ তাদের কাজের মাধ্যমে সক্রিয় শিখনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত চার্লস সি. বনয়েল ও জেমস এ. এইসনের ‘সক্রিয় শিখন: শ্রেণিকক্ষে আনন্দ-উচ্ছ্বাস’ একটি যুগান্তকারী গবেষণা।
এখানে তারা বলেন, সমস্যা সমাধানে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীরা অবশ্যই পড়বে, লিখবে, আলোচনা করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তারা বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়নধর্মীর মতো উচ্চতর চিন্তন দক্ষতার কাজে নিজেদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করবে। এক্ষেত্রে যে কৌশলটি প্রস্তাব করা যায় তা হলো, শিক্ষার্থীদের কোনো কাজে সংযুক্ত করা এবং একইসঙ্গে সেটি সম্পর্কে চিন্তায় উদ্বুদ্ধ করা।
পরবর্তীকালে শত শত গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সক্রিয় শিখনের কলাকৌশল শুধু উচ্চতর চিন্তন দক্ষতাই বৃদ্ধি করে না বরং শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের গভীরতাও বাড়িয়ে তোলে এবং তাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা ভিন্ন পরিস্থিতিতে স্থানান্তর করতে সাহায্য করে। এই শিখন পদ্ধতি অনুসরণ করে শিক্ষক একটি গতানুগতিক শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত করে তুলতে পারেন। তিনি তার বক্তৃতার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষার্থীদের একক, জোড়ায় ও দলগত কাজ দিয়ে এবং আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে কোনো বিষয়ের ওপর শ্রেণি কার্যক্রমকে অগ্রসর করতে পারেন।
এই পদ্ধতিতে শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে কুশল বিনিময়ের পর প্রথমেই শিক্ষার্থীদের পূর্বজ্ঞান যাচাই করেন। তারপর তিনি শিক্ষক সহায়িকায় বর্ণিত নির্ধারিত যোগ্যতা ও সুনির্দিষ্ট শিখনফল অনুযায়ী নতুন পাঠ সম্পর্কিত ধারণার বিস্তার ঘটান।
এক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন উপকরণ ব্যবহার করেন। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এরপর তিনি শিক্ষার্থীদের কয়েকটি দলে বিভক্ত করে পাঠের বিভিন্ন অংশ থেকে সমস্যা সমাধানমূলক কাজ দেন। এরপর তিনি তাদের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানতে চান এবং ফলাবর্তন প্রদান করেন। এ ছাড়া শিক্ষক পাঠ চলাকালে এবং পাঠ শেষে প্রতিটি শিক্ষার্থীর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করে গাঠনিক মূল্যায়ন সম্পন্ন করেন।
গবেষণায় দেখা যায়, মানুষের মনে রাখা ১০ শতাংশ পড়ার, ২০ শতাংশ শোনার, ৫০ শতাংশ দেখা ও শোনার, ৭০ শতাংশ বলা ও লেখার এবং ৯০ শতাংশ কোনো কিছুতে সংযুক্ত হওয়ার ওপর নির্ভর করে। আরো দেখা যায়, বক্তৃতা পদ্ধতিতে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থীদের চেয়ে সক্রিয়ভাবে সমস্যার সমাধানে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা ২০ শতাংশ বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছে। গতানুগতিকভাবে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা যেখানে ৫৫ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছে, সেখানে সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা ৮৫ শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছে।
সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে ২০ থেকে ২৫ জন, ৩০ থেকে ৪০ জন কিংবা ৬০ থেকে ৮০ জনের শ্রেণি কক্ষেও শিক্ষার্থীরা উচ্চতর চিন্তন দক্ষতা অর্জন করতে পারে। এখানে শিক্ষক শ্রেণি সময়কে কয়েকটি অংশে ভাগ করে বিভিন্ন শিখন কৌশলের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীর আগ্রহ ও কৌতূহলকে জাগিয়ে তুলেন। এভাবে তাদেরকে পাঠের বিষয়বস্তুর প্রতি মনোযোগী ও চিন্তাশীল করে তুলেন। ফলে এই পদ্ধতিতে শিক্ষক শুধু সহায়তাকারী নন, বরং শিখন প্রক্রিয়ার প্রভাবক ও মেন্টর।
শ্রেণি শিক্ষকদের সৃজনশীল তৎপরতায় পৃথিবীতে সক্রিয় শিখনের নতুন নতুন কলাকৌশল আবিষ্কৃত হচ্ছে। এক্ষেত্রে কয়েকটি জনপ্রিয় কৌশল হলো: এক মিনিটে লেখা, প্রতিফলনের জন্য থামা, নিজের কাজের মূল্যায়ন, থিংক-পেয়ার-শেয়ার, বড় দলে আলোচনা, অনানুষ্ঠানিক দল, বন্ধুদের নিয়ে মূল্যায়ন, বুদ্ধি খাটানো, কেস স্টাডি, রোল-প্লে, জিগসো আলোচনা, অনুসন্ধানী শিখন, ফোরাম থিয়েটার, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখন ইত্যাদি। বাংলাদেশের পরিমার্জিত প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ২০২১ এ সক্রিয় শিখনের ১৭১ টি কলাকৌশল অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এবং স্ব-উদ্ভাবিত কৌশল প্রয়োগের সুযোগ রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, ডেভিড কোবের শিখন পদ্ধতির প্রথম ধাপেই রয়েছে প্রেক্ষাপট নির্ভর অভিজ্ঞতা। কোনো বিষয়ের পূর্বজ্ঞান পর্যালোচনা না করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে শিখন শুরু করলে পাঠ বা টেক্সটের গুরুত্ব কমে যায়। গণিত ও বিজ্ঞানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র ও তত্ত্ব অভিজ্ঞতা থেকে পাওয়া যায় না বিধায় সেগুলোর জন্য মানসম্পন্ন পাঠ্য বই চর্চার বিকল্প নেই। সে কারণে প্রেক্ষাপট নির্ভর অভিজ্ঞতা থেকে শুরু না করে পাঠ্যবই থেকে শুরু করে অভিজ্ঞতার দিকে অগ্রসর হলে শিখন ত্বরান্বিত হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাস্তবে ডেভিড কোবের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখনের চারটি ধাপের কার্যক্রম ধারাবাহিকভাবে সম্পাদিত না হয়ে দুই তিনটি ধাপ একই সাথে সম্পন্ন হতে পারে। অগ্রসর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এভাবেই শিখন সংঘঠিত হয়ে থাকে। তা ছাড়া, শিখনকে স্থায়ী স্মৃতির সঙ্গে যুক্ত করতে গেলে অভিজ্ঞতার চেয়ে চিন্তন প্রক্রিয়াকে কার্যকর করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সক্রিয় শিখন পদ্ধতিতে এই বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
কাজেই একুশ শতকের যোগ্যতা অর্জনে ডেভিড কোবের অভিজ্ঞতা ভিত্তিক শিখন পদ্ধতির চার ধাপের বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষককে সক্রিয় শিখনের মুক্ত-স্বাধীন কলাকৌশল প্রয়োগে উৎসাহিত করাই হবে যুক্তিসংগত ও বাস্তব ভিত্তিক পদক্ষেপ।
লেখক: সাবেক সদস্য, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।