বাংলাদেশ সচিবালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (এও) এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের (পিও) জন্য সহকারী সচিব (নন-ক্যাডার) পদে এক-তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষণের বিধান থাকলেও সেই বিধান মানা হচ্ছে না বলে অভিযোগ সচিবালয়ের এও-পিওদের। তাঁরা বলছেন, বর্তমানে তাঁদের পদোন্নতির জন্য ক্যাডারবহির্ভূত ২৬৭টি সহকারী সচিব, ৭২টি সিনিয়র সহকারী সচিব ও ৯টি উপসচিব পদ আছে। সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের ১৮৪টি এবং উপসচিবের ৬২টিসহ আরো মোট ২৪৬টি পদ তাঁদের প্রাপ্য। প্রাপ্যতা অনুযায়ী নন-ক্যাডার পদ সংরক্ষণ নিয়ে ৩০ বছর ধরে টালবাহানা করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এ নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন সচিবালয়ের প্রায় তিন হাজার নন-ক্যাডার কর্মকর্তা।
বিষয়টি আগামীকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে নন-ক্যাডার পদ সংরক্ষণসংক্রান্ত কমিটি। ২০ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য ভবিষ্যতে সহকারী সচিব বা সিনিয়র সহকারী সচিব বা উপসচিব বা যুগ্ম সচিবের নতুন তৈরি করা পদের এক-তৃতীয়াংশ হিসেবে নন-ক্যাডারদের জন্য সংরক্ষণের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এই কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ৯ সদস্যের কমিটিতে আছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (শৃঙ্খলা ও তদন্ত), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অতিরিক্ত সচিব (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ অনুবিভাগ), অতিরিক্ত সচিব (সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ), অতিরিক্ত সচিব (বিধি), যুগ্ম সচিব (সচিবালয় ও কল্যাণ অধিশাখা), লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের যুগ্ম সচিব, অর্থ বিভাগের যুগ্ম সচিব।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ঊর্ধ্বতন নিয়োগ) কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। তবে বিষয়টি নিয়ে কমিটিসংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
অতিরিক্ত ২৪৬টি পদ সংরক্ষণের দাবিতে সচিবালয়ের কমবেশি ১০টি সংগঠন কয়েক বছর ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়ে আসছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে আবেদন দিয়েছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মজীবী কল্যাণ পরিষদ, বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী লিয়াজোঁ কমিটি, বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয় ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয় সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কম্পিউটার অপারেটর কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয় অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কল্যাণ সমিতি, বাংলাদেশ সচিবালয় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর কল্যাণ সমিতি এবং বাংলাদেশ সচিবালয় অফিস সহায়ক (১৭-২০) কল্যাণ সমিতি।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতেও একই দাবি জানিয়েছে ‘সরাসরি নিযুক্ত এও-পিও সমিতি’। এসব সংগঠনের নেতাদের নিয়ে একাধিকবার বৈঠকও করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সবশেষ গত ২০ অক্টোবর এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি।
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছরের সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে দেখা করেছেন। দফায় দফায় আশ্বাস পেলেও দাবি মানতে অনীহা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের।
বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে কর্মরত প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা মনে করেন, ‘তাঁদের পদোন্নতি পাওয়ার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।’
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) ও বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (সচিবালয়) ক্যাডার একীভূত হয়। এসংক্রান্ত আদেশে সচিবালয়ের ভিত্তিপদ সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের মোট পদের এক-তৃতীয়াংশ নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য রাখতে বলা হয়। প্রশাসন ও সচিবালয় ক্যাডার একীভূত করার সুপারিশ করে এসএম আকরাম কমিটি। ওই কমিটির সুপারিশে বলা হয়, ভবিষ্যতে সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে নতুন পদ সৃষ্টি হলে নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য আনুপাতিক হারে পদ সংরক্ষণ করতে হবে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা এসব নন-ক্যাডার পদের ফিডার হিসেবে পদোন্নতিযোগ্য হবেন। সেই হিসেবে নন-ক্যাডার সহকারী সচিবের জন্য ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের পর বিভিন্ন সময়ে সৃষ্ট পদের আনুপাতিক ২৬৭টি এবং সিনিয়র সহকারী সচিবের ৭২টি পদ সংরক্ষিত। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ইকোনমিক ও প্রশাসন ক্যাডার একীভূত হওয়ার সময় আকরাম কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সিনিয়র সহকারী প্রধান ও সহকারী প্রধানের ৪০৪টি পদ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত হয়। এর এক-তৃতীয়াংশ হিসেবে ১৩৫টি পদ নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য রাখার কথা। অপর এক আদেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সহকারী সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিবের ১১১টি পদ সংরক্ষণ করা হলেও আবার তা কমিয়ে ৭২টি সংরক্ষণ করা হয়। অর্থাৎ কেটে দেওয়া হয় ৩৯টি পদ। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের পর সহকারী সচিব/সিনিয়র সহকারী সচিবের ৩০টি নতুন পদ সৃজন করা হলেও সংরক্ষণ করা হয়নি এর এক-তৃতীয়াংশ। এ অনুযায়ী সহকারী সচিবের (নন-ক্যাডার) বিদ্যমান পদের বাইরে আরো ১৮৪টি পদ ক্যাডারবহির্ভূত কর্মকর্তাদের প্রাপ্য। একইভাবে উপসচিবের ক্ষেত্রে ২৬টি পদ সংরক্ষণের কথা থাকলেও করা হয় মাত্র ৯টি। বাকি ১৭টিসহ পরবর্তীকালে পদ বৃদ্ধির কারণে আনুপাতিক হারে পদ সংরক্ষণের কোটা বেড়ে দাঁড়ায় ৬২টিতে।
সরাসরি নিযুক্ত এও-পিও সমিতির সভাপতি শফিউদ্দিন শেখ বলেন, ‘সচিবালয়ের নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ পদ সংরক্ষণের বিধান থাকলেও ৩০ বছর ধরে তা মানা হচ্ছে না। আমরা প্রতিকার চাই।’ দ্রুত নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সচিবালয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নুরুজ্জামালও।