দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের চিরকুট জন্ম দিচ্ছে অনেক প্রশ্নের। সেই চিরকুটে বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্টকে একটি নির্ধারিত রোল নম্বরের পুনর্নিরীক্ষণের সব প্রক্রিয়া বন্ধ রাখার নির্দেশনা দিয়েছিলেন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। কিন্তু এই রোল নম্বরের পুনর্নিরীক্ষণ আবেদন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল এবং পরীক্ষার্থীর পক্ষে অন্য কেউ তা আবেদন করেছে মর্মে থানায় জিডিও হয়েছিল। পরে পাল্টা জিডি এবং সাইবার আদালতে মামলা, মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে মুক্তিযোদ্ধাদের মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন হয়েছে। আর এখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের চিরকুট ফাঁস হওয়ার পাশাপাশি ফলাফল প্রকাশের ছয় মাস অতিবাহিত হওয়ার আগেই এইচএসসি পরীক্ষার ওএমআরশিট বিক্রির দরপত্র আহ্বান করায় ফলাফল প্রক্রিয়ায় অনিয়মের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে চাইছেন বলে দাবি করেছেন মামলার বিবাদীরা। রোববার (১০ মার্চ) দৈনিক দেশ রুপান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন ভূঁইয়া নজরুল।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বর্তমান সচিব ও চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা নারায়ণ চন্দ্রনাথের ছেলে নক্ষত্র দেবনাথ ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন। গত ২৬ নভেম্বর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনের সময় জানতে পারেন কে বা কারা নক্ষত্র দেবনাথের রোল নম্বর ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর ব্যবহার করে সব বিষয়ের পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছেন। কিন্তু নক্ষত্র দেবনাথ শুধু বাংলা বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এ কারণে তিনি বাংলা বিষয়ে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করতে গেলে বিষয়টি জানতে পারেন। পরে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পুনর্নিরীক্ষণের জন্য আবেদন করেছে অভিযোগ করে নক্ষত্র দেবনাথের মা বনশ্রী নাথ পাঁচলাইশ থানায় জিডি করেন গত ৪ ডিসেম্বর। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এএমএম মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চিরকুটটিও ৪ ডিসেম্বরের। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সিনিয়র সিস্টেম অ্যানালিস্টকে উদ্দেশ্য করে সেই চিরকুটের একটি নির্দিষ্ট রোল নম্বর উল্লেখ করে লেখা হয় পুনর্নিরীক্ষার আবেদনের সব প্রক্রিয়া বন্ধ রাখুন।’
আরও পড়ুন:
সচিবপুত্রের এইচএসসি ফল তদন্তের দাবি সাবেক সচিবের
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও, অনশনসহ কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি
এ বিষয়ে একটি অভিযোগ সংবাদকর্মীদের কাছে প্রথমেই ছিল যে নক্ষত্র দেবনাথের পক্ষে একটি আবেদন করা হয়েছিল, সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিরীক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য কম্পিউটার শাখাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তখন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘একজনের আবেদন আরেকজন করা ক্রাইম। আর পুনর্নিরীক্ষণ বন্ধ করার জন্য সচিবের ছেলের কোনো আবেদন আমার হাতে আসেনি।’ আবেদন করলে পুনর্নিরীক্ষণ কার্যক্রম বন্ধ করা যায় কি না, এই প্রশ্নের পাল্টা জবাবে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বলেছিলেন, ‘এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার বোর্ড চেয়ারম্যানের।’ এই বক্তব্য গত ৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছিল।
এখন চিরকুট ফাঁস হওয়ার পর পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘চিরকুট একটি গোপনীয় বিষয়। গোপনীয় বিষয় মিডিয়ার কাছে কীভাবে গেল, সেটাই তো প্রশ্ন। তবে এই পুনর্নিরীক্ষণ কার্যক্রম বন্ধের বিষয়টি যথাযথ প্রক্রিয়ায় নেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে তখন চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা ও গত ১৭ জানুয়ারি অবসরে যাওয়া প্রফেসর মোস্তফা কামরুল আখতার বলেন, ‘আমি অবসরে চলে এসেছি। এ ছাড়া ঘটনাটি অনেক আগের হওয়ায় আমার পুরোপুরি মনেও নেই। তবে বোর্ড অ্যাক্ট অনুযায়ী পরীক্ষা পরিচালনার সব দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ওপর বর্তায়।’
প্রফেসর মোস্তফা কামরুল আখতারের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে থাকা একাধিক শিক্ষাবিদ। বিব্রত এড়াতে তাদের কেউ নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পরীক্ষা বিধিমালা অনুযায়ী সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের রয়েছে। এ ছাড়া যেহেতু এই পরীক্ষার্থী নিজে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেনি বলে থানায় জিডি করেছেন, তাই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক চাইলে এর পুনর্নিরীক্ষণ বন্ধ করতেই পারেন। তবে সমালোচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে তিনি নিরপেক্ষ অবস্থায় থাকবেন কি থাকবেন না, এটা একান্তই ওনার নিজস্ব মতামত।
আরও পড়ুন:
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে অনিয়মে বেপরোয়া নারায়ণ
কিন্তু এ ঘটনায় থানায় জিডি হয়েছে। জিডির রিপোর্টে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদনে রেফারেন্সে বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীমের মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে বলে তদন্তে উঠে আসে। নিজের নাম কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে অভিযোগ করে পাল্টা জিডি করেন প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীম। পরে জিডির রিপোর্টের ভিত্তিতে সাইবার ক্রাইমে কাউন্টার টেররিজমে মামলা করেন সচিবের স্ত্রী বনশ্রী নাথ। সেই মামলায় প্রফেসর আবদুল আলীমকে এক নম্বর ও মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ইদ্রিস আলীকে দুই নম্বর বিবাদী করা হয়। প্রফেসর ইদ্রিস আলী ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট করায় বিবাদী করা হয়। এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযোদ্ধারা মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে এই চিরকুটই প্রমাণ করে সচিবের ছেলের পরীক্ষার ফলাফলে অনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করেন প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীম। তিনি বলেন, ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক যদি স্বচ্ছ থাকতেন তাহলে পুনর্নিরীক্ষণ হলে সঠিক তথ্য বের হয়ে আসত। এখন নিরীক্ষণ করতে না দিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হলো।’ একই মন্তব্য করেন মামলার দুই নম্বর বিবাদী প্রফেসর ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘নিরীক্ষণ হলে সঠিক তথ্য সবাই জানতে পারত। কিন্তু এখানে সেই পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের তখনকার চেয়ারম্যান প্রফেসর মোস্তফা কামরুল আখতার বলেন, ‘পুনর্নিরীক্ষণে কখনো কারও রোল নম্বর জানার সুযোগ নেই। কোড নম্বর অনুযায়ী খাতার বান্ডেল থেকে খাতা বের করা হয় এবং নম্বর নিরীক্ষণ করা হয়। আর নিরীক্ষণে যদি নম্বর পূর্ববর্তী নম্বরের চেয়ে কমও পাওয়া যায় তাহলেও আগের বেশি নম্বরই বলবত থাকে। কম্পিউটার আগের চেয়ে কম নম্বর নেবে না, বেশি নম্বর হলেই তা পরিবর্তন হবে।’
মামলার আলামত নষ্টের অভিযোগ বর্তমান চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে : চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সচিব ও চেয়ারম্যানের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্রনাথ ৩ মার্চ ২০২৩ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ওএমআর, প্রশ্নপত্রসহ পাঁচ ধরনের পরীক্ষার উপকরণ বিক্রির জন্য দরপত্র আহ্বান করেন। আজ ১০ মার্চ দরপত্র দাখিলের শেষ দিন। এদিকে এই দরপত্রের মাধ্যমে পরীক্ষায় অনিয়মের সব আলামত নষ্ট করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মামলার বিবাদীরা। এ বিষয়ে প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীম বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের ছয় মাস পর এগুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে। এখন তড়িঘড়ি করে বিক্রি করা হচ্ছে কেন? মামলার আলামত নষ্ট করতেই এগুলো করা হচ্ছে।’ একই মন্তব্য করেন প্রফেসর মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদের দোষী প্রমাণ করার জন্য বাদী ইচ্ছাকৃতভাবে পরীক্ষার ওএমআরশিটগুলো বিক্রি করে দিচ্ছেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটে দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নগর পুলিশের পরিদর্শক সঞ্জয় গুহ বলেন, ‘আমাদের এখানে দায়ের করা মামলা ফলাফল নিয়ে নয়। কে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছে এবং সাইবারসংক্রান্ত। ফলাফল প্রক্রিয়া নিয়ে এই মামলায় কোনো তদন্ত হবে না।’
তবে ফলাফল প্রকাশের ছয় মাস আগে এসব উপকরণ বিক্রির নিয়ম নেই বলে উল্লেখ করেন কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘২০২৩ সালের এসএসসি পরীক্ষার খাতা বিক্রির সময় হলেও এইচএসসিরগুলো এখনো বিক্রির সময় হয়নি।’ এদিকে এসব উপকরণ বিক্রির জন্য শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক থেকে একটি চিঠি চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মজিবুর রহমান গত ৩০ জানুয়ারি এসএসসি পরীক্ষার উত্তরপত্র বিক্রির জন্য চিঠি লিখলেও এইচএসসির জন্য কোনো চিঠি এখনো লেখেননি বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান সচিব প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্রনাথ বলেন, ‘আমরা এসএসসিরগুলো এখন বিক্রি করব, এইচএসসিরগুলো বিক্রির কার্যাদেশ দেব নির্ধারিত সময়ের পর। দরপত্রের নিচে তা লেখা রয়েছে। আর বোর্ডের খরচ বাঁচানোর জন্য এক আদেশে দুটো করা হয়েছে।’
তবে প্রফেসর মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেন, এসএসসিরগুলো বিক্রির সময় যদি কৌশলে এইচএসসির ওএমআর বিক্রি করে দেওয়া হয়, তাহলে তা বোঝা যাবে না।