পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে শ্বেতপত্র-১সত্তুরেই অকুতোভয় মুক্তিকামি বাঙালি

সিদ্দিকুর রহমান খান |

মুক্তিকামী বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলন পাকিস্তানের চোখে ছিলো গুন্ডামি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা। ওসব ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিলো তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগ। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৫ আগস্ট। পুরনো নথির জঞ্জাল থেকে উদ্ধার করে ওই শ্বেতপত্রটি সম্প্রতি নতুন করে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর (ডিএফপি)। যার উদ্যোক্তা ডিএফপি মহাপরিচালক স. ম. গোলাম কিবরিয়া। ওই শ্বেতপত্রের প্রথম কিস্তিতে আজ থাকছে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি থেকে ২০ অক্টোবর পযন্ত ঘটা ঘটনার চুম্বক অংশ। আজকের প্রতিবেদনে জামায়াতসহ পাকিস্তানপন্থি দলগুলোর সঙ্গে আওয়ামী লীগসহ স্বাধীনতাকামী দলগুলোর সম্পর্ক, পাকিস্তানপন্থি খবরের কাগজগুলোর খবর প্রকাশের ধরন ও প্রবণতা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষের বিভিন্ন তৎপরতা বর্ণিত হয়েছে। 

এক. ঢাকায় পুরানা পল্টন ময়দানে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি. পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য একটি দলের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভা জনতা কর্তৃক আক্রান্ত হয়। ফলে একজন লোক নিহত এবং পাঁচ শতাধিক লোক আহত হয়। জামায়াত ই ইসলামী এই সভার আয়োজন করেছিল। জামায়াত ই ইসলামী প্রমাণ করেছিল যে ময়দানে ঢুকে যারা শ্রোতাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগ কর্মীরা ছিল এবং গুন্ডাদের হাতে অস্ত্রশস্ত্র এবং হাত বোমা ছিলো।

ঢাকার দৈনিক পত্রিকা পাকিস্তান অবজারভার এই ঘটনাকে নিন্দা করে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ জানুয়ারি প্রকাশ করে যে, সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলে দলে দলে লোকের আগমন, সভা পন্ড করা, মঞ্চ পুড়িয়ে ফেলা এবং কয়েক হাজার শ্রোতাকে তাড়িয়ে দেয়ার ঘটনা প্রমাণ করে যে, এটা একটা সুপরিকল্পিত এবং সংকল্পবদ্ধ প্রচেষ্টা। তা না হলে এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু বিনষ্ট করা সম্ভব হতো না।

এই ঘটনার এক সপ্তাহ পর পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে আরেকটি দলের একটা জনসভায় মারপিট হয়। ১৭ জন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যুক্ত ইশতেহারে এর নিন্দা করে বলে কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী এবং গুণ্ডা সুসংঘবদ্ধভাবে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের একুশে জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভা পন্ড করে দেয়ার চেষ্টা করে। সেই একই দিনে (একুশে জানুয়ারি ১৯৭০ ) পৃথক একটি যুক্ত বিবৃতিতে এই নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগকে গুন্ডামি এবং সন্ত্রাসী নীতি অবলম্বন করার জন্য বিশেষভাবে দোষারোপ করেন।

দুই. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জানুয়ারি ঢাকায় জামায়াত ই ইসলামী দপ্তরে হামলা করা হয়। পার্টি জেনারেল সেক্রেটারি এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, আমাদের দপ্তরে হামলা চালানোকালে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ধারা পরিচালিত গুন্ডারা দরজা ভেঙে ঢুকে আসবাবপত্রাদি ভেঙে তছনছ করে সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলে এবং পার্টির কাগজপত্র দলিল এবং পতাকায় আগুন ধরিয়ে দেয়।

তিন. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি, ঢাকায় পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির এক জনসভায়ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা গোলযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা জয় বাংলা স্লোগান দেয়। গোলযোগের মধ্যে নিজাম ই ইসলাম পার্টির নেতা মৌলভী ফরিদ আহমেদ প্রমুখ আহত হন।  

চার. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামে দৈনিক বুনিয়াদ এবং দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার দপ্তর দুটির উপর হামলা করা হয়। এই দুটি পত্রিকা আওয়ামী লীগ বিরোধী বলে পরিচিত ছিল।

পাঁচ. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ শে জুলাই ঢাকার পাকিস্তান অবজারভারসহ কয়েকটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, আওয়ামী লীগের পাঁচ শতাধিক সশস্ত্র কর্মী হালিশহর হাউসিং এস্টেটের অধিবাসীদের আক্রমণ করে এর ফলে ২২ জন আহত হয়। তার মধ্যে ৭ জনের অবস্থা গুরুতর। খবরে জানা যায় যে, আওয়ামী লীগ কর্মীরা চেয়েছিলেন উল্লেখিত লোকেরা ধর্মঘট পালন করুক। কিন্তু সেই এলাকার অধিবাসীরা তা করতে অস্বীকার করে।

ছয়. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগস্ট দৈনিক পূর্বদেশ এর খবরে প্রকাশ, ২ আগস্ট ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ টাউন ময়দানে পিডিপির এক সভা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগের একটি দল এবং ছাত্রলীগ কর্মীরা গোলযোগ বাঁধানোর চেষ্টা করে।

খবরে প্রকাশ, সভাস্থানের সন্নিকট শেখ মুজিবুর রহমানের গোপালগঞ্জস্থ বাসভবন থেকে, সভায় গোলযোগ সৃষ্টিকারী আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগ কর্মীদের বের হয়ে আসতে দেখা যায়।

সাত. ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার খবরে জানা যায়, চট্টগ্রামের দৈনিক আজান পত্রিকার দফতর ছাত্র বলে পরিচিত একদল যুবক কর্তৃক আক্রান্ত হয়। দুষ্কৃতিকারীরা ৬ দফার সমর্থনে জয়বাংলা শ্লোগান দিচ্ছিলো। আজান কর্তৃপক্ষকে তার ৬ দফা সমর্থন করে তাদের পত্রিকায় লেখার হুকুম করে।  পত্রিকার একজন কর্মচারী হামলার সময় আহত হন।

আট. ঈশ্বরদীর ইসলামী ছাত্রসংঘের জেনারেল সেক্রেটারিকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীরা আক্রমণ করে। চাঁদপুর শহরের কাছে বাহুরীবাজারে  ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ কর্মীর নিজাম—ই—ইসলামের অফিসে হামলা করে এবং অফিসের আসবাবাদি বিনষ্ট করে বলে খবর পাওয়া যায়।

নয়. ঢাকার দৈনিক পত্রিকা সংবাদ এর ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২০ অক্টোবরের খবরে প্রকাশ, ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ অক্টোবর ঢাকার হাজারীবাগ এলাকার ১৩ নং রাস্তার বাচ্চু মিয়ার বাসভবনে আওয়ামী লীগের একদল দুষ্কৃতিকারীরা আক্রমণ করে। দুষ্কৃতিকারীরা বাড়ীর উপর পাথর নিক্ষেপ করে, বাড়ীর মেয়েদের গালিগালাজ করে এবং দু'টি নাবালক ছেলের উপর দৈহিক নির্যাতন চালায়। (চলবে) 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের - dainik shiksha ‘২৬ লাখ টাকা’র প্রধান শিক্ষক নাজমার শাস্তি দাবি আনন্দময়ী স্কুল ছাত্রীদের জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha জানুয়ারিতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেয়া হবে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: ব্যাংক হিসাব নিয়ে এমপিও শিক্ষকদের অসন্তোষ পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক - dainik shiksha পবিপ্রবিতে গাঁজাসহ ৫ মাদকসেবী আটক ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ভর্তিতে লটারি বাতিলের দাবিতে সড়ক আটকে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন - dainik shiksha প্রাথমিকের ১০ম গ্রেডের দাবি সর্বজনীন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0034589767456055