দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক: দেশ জুড়ে তাপপ্রবাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। গরমজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া রোগী বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ ও কো-মর্বিডিটির (অন্যান্য রোগে আক্রান্ত) রোগীরা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গরমে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। এ সময় মানুষের মৃত্যু ও অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য কারণ হিসেবে অধিকাংশ সময়ই বলা হচ্ছে ‘হিট স্ট্রোক’। তবে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষকরা এই ‘হিট স্ট্রোক’ শব্দের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন। তারা বলেন, এখন দেশে মানুষ যে অসুস্থ হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে, সেটার কারণ প্রচণ্ড গরম। হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়ার মতো তাপমাত্রা দেশে এখনো হয়নি। মানুষ এখন অসুস্থ হচ্ছে বা মারা যাচ্ছে ‘হিট এক্সরশন’-এর কারণে, ‘হিট স্ট্রোকে’ নয়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন গতকাল রোববার বলেন, ‘হিট স্ট্রোকে মারা যাওয়ার মতো তাপমাত্রা এখনো আমাদের দেশে হয়নি। হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে বলে যা বলা হচ্ছে সেটা সঠিক কথা না।’
বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘দেশে এখন যেটা হচ্ছে সেটা হিট এক্সরশন। হিট স্ট্রোক এক জিনিস আর হিট এক্সরশন আরেক জিনিস। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুটোর প্রতিক্রিয়া, ম্যাকানিজম (কৌশল বা পদ্ধতি) ও চিকিৎসাও ভিন্ন। রোগীর উপসর্গও ভিন্ন। আমরা যে বলি মানুষ হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে, এটা একদম ঠিক না। কারণ হিট স্ট্রোক ভিন্ন জিনিস।’
গতকালও দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় মৃদু থেকে অতি তীব্র তাপপ্রবাহ অব্যাহত ছিল। গতকাল নতুন করে আরও তিন দিনের সতর্কতা জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অধিদপ্তর বলেছে, এ সময় বাতাসে জলীয়বাষ্পের আধিক্যের কারণে গরমে অস্বস্তিকর অনুভূতিও বাড়বে।
হিট স্ট্রোকে না, মৃত্যু হিট এক্সরশনে : বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদের (বিএমআরসি) পরিচালক অধ্যাপক ডা. রুহুল আমিন বলেন, ‘হিট স্ট্রোকে মারা যেতে হলে কোনো ব্যক্তিকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার ওপরে পড়তে হবে। দু-একটি জেলা ছাড়া ঢাকাসহ কোথাও সেই তাপমাত্রা হয়নি। মানুষ হিট বা তাপমাত্রার জন্য মারা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা হিট স্ট্রোক না। হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে এটা ঠিক না। আমরা বলতে পারি গরমজনিত অসুস্থতার কারণে মারা যাচ্ছে।’
একইভাবে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, ‘হঠাৎ করে কেউ যদি ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি তাপমাত্রায় পড়ে বা আক্রান্ত হয়, সেটাকে হিট স্ট্রোক বলে। আমাদের দেশে সকাল থেকে সারা দিন প্রচণ্ড গরমের কারণে মানুষ যে অসুস্থ হয়ে পড়ছে, সেটা হিট এক্সরশন।’
এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা যে বলি মানুষ হিট স্ট্রোকে মারা যাচ্ছে, এটা একদম ঠিক না। কারণ হিট স্ট্রোক ভিন্ন জিনিস। আমার রুমে আগুন লাগল। আমি রুমে আটকে গেছি। সেখানে তাপমাত্রা হলো ৭০ ডিগ্রি। এই যে হঠাৎ তাপ বেড়ে যাওয়া, এটাকে বলে হিট স্ট্রোক। কিন্তু সারা দিনের প্রচণ্ড গরমের কারণে যে পরিবর্তন সেটা হিট এক্সরশন। এর কারণে শরীরে যে পরিবর্তনগুলো হলো হচ্ছে ঘাম হচ্ছে, শরীরের পানি চলে যাচ্ছে, লবণশূন্য হয়ে পড়ছে, এগুলো হিট এক্সরশনের ফসল।’
ডা. নিয়াতুজ্জামান আরও বলেন, ‘হিট স্ট্রোক হলো হঠাৎ করেই শরীর প্রচণ্ড গরম হয়ে যায়, শরীরের তাপমাত্রা বের হওয়ার যে পদ্ধতি সেগুলো অচল হয়ে যায়। যেমন ঘাম বন্ধ হয়ে যায়। শরীর থেকে তাপ নিঃসরণ হয় না। তখন শরীরের মেটাবলিক চেইন হয়ে যায়। শরীরের সমস্ত সিস্টেম (অঙ্গগুলো) হঠাৎ করে ফেইল (অচল) করে। কিন্তু হিট এক্সরশনে শরীরের সিস্টেমগুলো হঠাৎ ফেইল করে না। এখানে ধীরে ধীরে হয়। প্রথমে ঘাম হয়, শরীর থেকে লবণ বেরিয়ে যাবে। তখন শরীর ঠিকমতো কাজ করে না। যেমন : পটাশিয়াম কমে গেলে হার্টের রোগীর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়। ক্যালসিয়াম কমে গেলে হাত পা নিস্তেজ হয়ে যাবে, ঘাম হলে মানুষ হাঁটাচলা করতে পারে না, শরীর দুর্বল হয়ে যায়। সোডিয়াম কমে গেলে মাথা ঝিমঝিম করবে, এরপর খিঁচুনি হবে, এরপর অজ্ঞান হয়ে যাবে। ম্যাগনেশিয়াম কমে গেল পেশি সংকোচন ও শিথিল হয়ে যায়। পানিশূন্য হবে ও শরীর থেকে পানি ঝরে যাবে।’
‘হিট স্ট্রোকে শরীরের পানি কমে না, কারণ এটা আকস্মিক। স্ট্রোকের ১৫ মিনিটের মধ্যে শরীরের সবকিছু ফেইল করবে।’ বলেন এই বিশেষজ্ঞ।
বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু বৃদ্ধ : ডা. নিয়াতুজ্জামান বলেন, হিট এক্সরশনের শিকার বেশি হচ্ছে শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের অন্যান্য কো-মর্বিডিটি, যেমন : ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, রক্তচাপ, হৃদরোগ আছে, এমন মানুষ। হিট এক্সরশনের চিকিৎসা দিতে হয় উপসর্গ বোঝে। যদি শরীর পানিশূন্য হয় তাহলে ওআরএস বা তরল স্যালাইন বেশি করে খেতে হবে। ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষায় তরমুজ, ডাব, লবণমিশ্রিত শরবত খেতে হবে। এখন মূলত শরীর থেকে প্রচুর পানি বেরিয়ে যাচ্ছে। এই পানির সঙ্গে লবণ, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম যাচ্ছে। এর ফলে শরীর পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে শরীরে খুব দ্রুত কিছু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। সেই প্রতিক্রিয়ার কারণেই মানুষ অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে ও মৃত্যুবরণ করছে। যার বমি বা পেটে ব্যথা হচ্ছে, তাকে স্যালাইন ও পানি খেতে দিতে হবে, রিহাইড্রেট করতে হবে। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে তার চিকিৎসা।
দরকার প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা : এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাটা খুবই জরুরি বলে মনে করেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘হাতের কাছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা থাকলে প্রচণ্ড গরমে আক্রান্ত কোনো রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে বাঁচিয়ে তুলতে পারি। যেমন : ট্রাফিক পুলিশ বক্সে ফার্স্ট এইড থাকলে এবং প্রশিক্ষিত পুলিশ ও প্যারামেডিক রাখলে, তারা রাস্তাঘাটে অসুস্থ বা অচেতন হয়ে পড়া পথচারী বা রিকশা-ভ্যান শ্রমিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দিতে পারেন। তাহলে আমরা অনাবশ্যক মৃত্যু ঠেকাতে পারি।’