ভৈরবে রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মোক্তার হোসেন ও সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা সুলায়মানের বিরুদ্ধে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বরাবর এলাকাবাসীর করা লিখিত অভিযোগে প্রধান শিক্ষক মো. মোক্তার হোসেনের এক বছরের কর্মকালে ডজন খানের আর্থিক অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের চিত্র তুলে ধরা হয়।
জানা যায়, মোক্তার প্রধান শিক্ষক হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে যোগদানের পর ২রা জুলাই ২০২২ থেকে ৩০শে জুন ২০২৩ পর্যন্ত সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের যৌথ স্বাক্ষরে মোট ১ কোটি ৪৩ লাখ ৭৬ হাজার ৬১৫ টাকা বিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল থেকে উত্তোলন করেছেন। এ বিপুল পরিমাণে টাকা ব্যয়ের ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটির কোনো অনুমোদন নেয়া হয়নি।
শিক্ষক ম্যানেজিং কমিটির সমন্বয়ে করা হয়নি কোনো ক্রয় কমিটি। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল থেকে খেয়াল খুশিমতো টাকা উত্তোলন করেছেন এবং তাদের ইচ্ছানুযায়ী ব্যয় ভাউচার করে এগুলো আত্মসাৎ করার চেষ্টা করেছেন, যা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি।
বিদ্যালয়ের পূর্বপাশে দ্বিতলা করার সময় প্রায় ১২০ ফিট লম্বা ও ৩৫ ফিট প্রস্থবিশিষ্ট টিনশেড ভবনের টিন ও কাঠ প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি যোগসাজশ করে বিক্রি করেছেন। নিয়ম অনুযায়ী দরপত্র আহ্বান (টেন্ডার) করে স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এবং এলাকায় মাইকিং করে বিদ্যালয়ের মালামাল বিক্রি করতে হয়।
তাছাড়া শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সমন্বয়ে একটি বিক্রয় কমিটি করে ম্যানেজিং কমিটিতে অনুমোদন নিতে হয়। কিন্তু প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি মিলে কোনো প্রকার নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিদ্যালয়ের টিন-কাঠ বিক্রি করে সম্পূর্ণ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এক্ষেত্রে কতো টাকা বিক্রি হয়েছে তাও বিদ্যালয়ে জানানো হয়নি। টিন-কাঠ বিক্রির ১ বছর অতিবাহিত হলেও বিদ্যালয় তহবিলে কোনো টাকা জমা হয়নি। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক প্রতিনিধি ম্যানেজিং কমিটির সভায় বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করলে টিন-কাঠ বিক্রি বাবদ মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা জমা করা হয়।
বিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা সুলায়মান কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ের নামে প্রকল্প অনুমোদন করিয়েছেন। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে বিদ্যালয়ের ফটক টেন্ডার হলেও কন্টাক্টরের কাছ থেকে কাজ কিনে এনে বিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিল থেকে লাখ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক মোক্তার হোসেন যোগদান করার পর কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদ থেকে পূর্ব দিকের বিল্ডিং টিনশেড ২য় তলা করার কথা থাকলেও বিদ্যালয় তহবিল থেকে খরচ করা হয়েছে ৬০ লাখ টাকারও বেশি। কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের কাজের কোনো শিডিউল ম্যানেজিং কমিটিতে অনুমোদন করা হয়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি বিদ্যালয় তহবিল থেকে বিপুল পরিমাণের টাকা কাজের নামে আত্মসাৎ করেছেন এবং কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের ফাইল গায়েব করেছেন।
ভৈরবে তাহসিন এন্টারপ্রাইজের নামে বিদ্যালয়ের সাধারণ তহবিলের মোট ৩ লাখ ৭৬ হাজার ২০০ টাকা কম্পিউটারে তৈরিকৃত ভাউচার প্যাডে পরিশোধ করা হলেও তাহসিন এন্টারপ্রাইজ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নাই বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করেছেন।
বিদ্যালয়ের ভাউচার প্যাডে বিল করে রাজমিস্ত্রির মজুরি দেখানো হয়েছে ৫ লাখ ৮ হাজার ৬১০ টাকা। এই বিপুল পরিমাণে টাকা মজুরি দেখানো হলেও কতোজন রাজমিস্ত্রি ও কতোজন জোগালি কতোদিন কাজ করেছেন তার কোনো হিসাব নেই। এমনকি রাজমিস্ত্রি বা জোগালিদের কোনো গধংঃবৎ জড়ষষ করা হয়নি। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক মিলে যখন যা খুশি তাই করেছেন। আর্থিক শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার কথা ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করা হয়নি।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আর্থিক বিধিমালা অনুযায়ী প্রধান শিক্ষকের হাতে নগদ ৫ হাজার টাকার উপরে থাকার কোনো বিধান নেই। বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ অডিট কমিটি নিরীক্ষা কার্য সম্পাদনের পর প্রধান শিক্ষক মোক্তারের নিকট হতে হাতে নগদ ২ লাখ ৯১ হাজার ২০৮ টাকা পায়। নিয়মবহির্ভূতভাবে ২ লাখ ৯১ হাজার ২০৮ টাকা হাতে রাখার ব্যাপারে মোক্তার এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।
অভিযোগের বিষয়ে মোক্তার বলেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। যেসব অভিযোগ উঠেছে ওইসব অভিযোগের সবগুলোর সময়কাল আমার সময়ের না। আমাদের বিদ্যালয়ের অডিট কমিটি আছে। তারা হিসাবনিকাশ নিয়মিত অডিট করেন। খরচের ব্যাপারে তাদের কোনো আপত্তি নেই। অনেক কাজই চলমান ও দৃশ্যমান আছে। যার কারণে অভিযোগগুলো আমার ওপরে বর্তায় না।
এ বিষয়ে কথা বলতে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা সুলায়মানকে ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি একাধিক ফোন দিয়েও একাধিক ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও তিনি সাড়া দেননি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার শবনম শারমিন বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। এ বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।