সভ্য হন, আইন মানুন

প্রশান্ত কুমার কর্মকার |

একটা সময় ছিলো, এ দেশের মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে রাজনীতিবিদরা জেল জুলুমের শিকার হয়েছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনের বড় অংশ জেলে কাটিয়েছেন। ভারতে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও পরমাণু বিজ্ঞানী এপিজে আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, মুরগির ডিম ফুটে বাচ্চা হলে মুরগি হয়, কিন্তু মানুষের পেট থেকে বাচ্চা হলে মানুষ হয় না, তাকে মানুষ করতে হয়।

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সারা দেশে চারদিকে নির্বাচনী হওয়া বইছে। আবার নির্বাচনী মাঠে বিএনপি না এসে তারা অসহযোগ, হরতালসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বিএনপির মতো বড় একটি রাজনৈতিক দলের হাতে জনবান্ধব সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি না থাকায় গণমানুষ তা গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। রাজনীতির এই শূন্য মাঠে ঢুকে পড়েছে, অরাজনৈতিক ব্যক্তি। যারা কখনো গণমানুষের কথা ভাবেননি, আন্দোলন-সংগ্রামেও শামিল হননি।

নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই হন আইনপ্রণেতা। সেই জনপ্রতিনিধি ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠী প্রতিনিয়ত আইন ভঙ্গ করে চলছেন। 

বাংলাদেশ সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় সংসদ নামে বাংলাদেশের একটি সংসদ থাকিবে এবং এই সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রজাতন্ত্রের আইন প্রণয়ন ক্ষমতা সংসদের ওপর ন্যস্ত হইবে।’ আইন প্রণয়ন করা সহজ, কিন্তু তার বাস্তবায়ন করা ততোটাই কঠিন, যদি আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হয়। মহান জাতীয় সংসদের মর্যাদা রক্ষার্থে প্রণীত আইন পালনের মাধ্যমে সম্মান জানানো সময়ের দাবি।   

আইন আছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, নির্বাচন কমিশনার, ভ্রাম্যমাণ আদালত সবই আছে, তাতেও থেমে নেই আইন লঙ্ঘন করার প্রতিযোগিতা। জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছাড়াও অন্যান্য নির্বাচন এলেই নিয়মের বেড়াজাল ভেঙে প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় উচ্চ শব্দে মাইকিং করা হচ্ছে। নগর, মহানগর, শহর, গ্রামে-গঞ্জে বাসা-বাড়ির দেয়াল জুড়ে পোস্টারে পোস্টারে ও লিখনে ভরে যায়। এসব থেকে বাদ যায় না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি বেসরকারি ও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের দেয়াল এবং মন্দির, মসজিদ ও মাদরাসা। 

আমাদের প্রত্যাশা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ও পর পরাজিত-বিজয়ী প্রার্থীরা ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার আইন-২০১২’ আইনের প্রতি সম্মান দেখাবেন। একজন সচেতন রাজনীতিবিদ বা সচেতন নাগরিক বা আইনপ্রণেতা হিসেবে নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকা আইনে নির্ধারিত সময়ে থেকে পোস্টার, ব্যানার, দেয়াল লিখন অপসারণে উদ্যোগী হবেন। আমাদের মনে রাখা উচিত প্রতিটি আইনই মহান জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত। সেই আইন সংসদ সদস্যরা ভঙ্গ করুন তা আমাদের প্রত্যাশা নয়।

জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের পোস্টার ব্যানার লক্ষ্য করা যায় বছর জুড়ে। এতে নগরীর দৃষ্টিনন্দন সৌর্ন্দয্যের হানি ঘটে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতি হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশও নষ্ট হয়। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের চোখের সামনে পোস্টার, ব্যানার, মাইকিং করা হয়। নির্বাচিত প্রতিনিধিকে আইন মানতে হবে, তবেই সাধারণ জনগণ আইন মানতে উৎসাহিত হবে। 

২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ‘দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১২’ গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এই আইনের ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনে যা কিছুই থাক না কেনো, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক পরিচালিত, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নির্বাচনে, নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধি-বিধান এবং এতদুদ্দেশ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক জারীকৃত নির্দেশনা যদি থাকে, প্রযোজ্য হবে।

(২) এই আইনে যা কিছুই থাক না কেন, উপ-ধারা (১) এ উল্লেখিত নির্বাচন ব্যতিত অন্য কোনো নির্বাচনে, সংশ্লিষ্ট নির্বাচন পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নিকট হতে পূর্বানুমোদন গ্রহণ সাপেক্ষে, উক্ত স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত স্থান ও শর্তে, নির্বাচনী প্রচারণা সংক্রান্ত দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে; তবে শর্ত থাকে যে, অনুমোদিত পোস্টার বা দেয়াল লিখন নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার ১৫ (পনের) দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক অপসারণ বা মুছে ফেলা না হলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৬ ধারায় সাজা দেয়ার বিধান রয়েছে। 

নগরীর সৌন্দর্য্য রক্ষার স্বার্থে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ব্যস্ততম স্থানে পোস্টার লাগানোর জন্য বিশেষ বোর্ড স্থাপন করা হয়। যেখানে নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান তাদের পোস্টার লাগাতে পারবেন। কিন্তু রাজধানীর প্রধান সড়কের আশপাশসহ বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে যত্রতত্র পোস্টার, ব্যানার লাগানো হচ্ছে ও দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে। মেট্রোরেলের খুঁটি ও ব্যানার পোস্টারমুক্ত নয়। সড়কের আশপাশের দেয়াল, ভবন, গাছ, বৈদ্যুতিক খুঁটি, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদরাসার দেয়াল কিছুই বাদ যায়নি।  যার ফলে শুধু নগরীর সৌন্দর্যহানিই হচ্ছে না। এর সঙ্গে ক্ষতি বা নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। 

জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদরা প্রতিনিয়তই এই আইন ভঙ্গ করে চলেছেন। এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত প্রচার, স্কুল-কলেজে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি, কোচিং সেন্টারের পোস্টার, সিনেমা-নাটকের পোস্টারসহ বিভিন্ন ধরনের পোস্টারিং বছর জুড়েই দেখা যায়।   

সাধারণ নাগরিক, আইন প্রণেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই দেয়ালের পর দেয়াল জুড়ে পোস্টার লাগানো হচ্ছে। মাইকের উচ্চ শব্দে স্বস্তিতে কেউ কথা বলতে পারছেন না।  আইনের যথাযথ প্রয়োগ থাকলে, সচেতন নাগরিক হিসেবে সকলে আইন মেনে চললে শুধু নগরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়, জনবান্ধব ও দোষনমুক্ত স্বপ্নের নগরীর দেখা পেতেন নগরবাসী। 

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করেও পোস্টার উচ্ছেদসহ জড়িতদের অর্থদণ্ড করা হলেও যত্রতত্র পোস্টারিং ও দেয়াল লিখন বন্ধ হচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব পোস্টার, ব্যানার অপসারণ করা হচ্ছে। কিন্তু যদি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমুলক প্রত্যক্ষ শাস্তির ব্যবস্থা করা যেতো তবে দেয়াল লিখন, পোস্টার, ব্যানার লাগানোর যত্রতত্র ব্যবহার কমে আসতো। 

নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় আইন করা হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ হয়নি। আইনের ধারা ৪ অনুযায়ী নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে না। কিন্তু বিগত দশ বছরেও এ আইনটি বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারি কোনো সংস্থার ধারাবাহিক কার্যকরী উদ্যোগের দেখা মেলেনি। সিটি করপোরেশন নিজ উদ্যোগে ব্যানার ফেস্টুন অপসারণ করলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। আইনটি অকার্যকর আইনে পরিণত হয়েছে। 

অথচ আইনের ধারা-৪ এ বলা হয়েছে, কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানোর জন্য প্রশাসনিক আদেশ দিয়ে স্থান নির্ধারণ করে দিতে পারবে এবং নির্ধারিত স্থানে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, নির্ধারিত স্থান ছাড়াও অন্য কোনো স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে, দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাতে পারবেন। 

অপরাধ ও দণ্ড বিষয়ে আইনের ধারা ৬ এর উপধারা-২ এ বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগালে সেই অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৫ হাজার টাকা এবং ঊর্ধ্বে ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করা যাবে। অনাদায়ে ১৫  দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়ার বিধান রয়েছে। 

এ ছাড়া উপধারা-৩ এ বলা হয়েছে, কোনো সুবিধাভোগীর অনুকূলে ধারা ৩ ও ৪ এর বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো হলে উক্ত অপরাধের জন্য ওই সুবিধাভোগীর বিরুদ্ধে ১০ হাজার টাকা এবং ঊর্ধ্বে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৩০ দিন পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়ার সুযোগ আছে। আসুন আমরা আইন মেনে চলি ও সুনাগরিক হিসেবে দেশকে এগিয়ে নিতে অংশীদার হই। 

লেখক: সাংবাদিক ও আইনজীবী

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশ ১২ মে খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha খাড়িয়া ভাষা সংরক্ষণে উদ্যোগ গ্রহণের আহবান প্রধান বিচারপতির উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি - dainik shiksha উপবৃত্তির সব অ্যাকাউন্ট নগদ-এ রূপান্তরের সময় বৃদ্ধি শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা - dainik shiksha শিক্ষক হতে চান না শিক্ষক দম্পতিদের কৃতী সন্তানরা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0045409202575684