অর্থ পাচার, খুন-খারাবি, ঘুষ-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে বিচারাধীন থাকা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির আপন খালাতো ভাই জুলহাজ মান্নানের কথা মনে আছে হয়তো অনেকেরই। জুলহাজ মান্নান (Xulhaz Mannan) ছিলেন ঢাকাস্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ও বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সমকামীদের পত্রিকার রূপবান এর প্রতিষ্ঠাতা। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে ঢাকার কলাবাগানের অ্যাপার্টমেন্টে ছুরিকাঘাতে খুন হন জুলহাজ।
পাঠকের আরো মনে থাকার কথা, জুলহাজে খুন হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলে, "জনাব জুলহাজ মান্নানের উপর এই বর্বর আক্রমণে আমরা ক্ষুব্ধ, তিনি আমাদের দূতাবাস পরিবারের একজন অত্যন্ত প্রিয় সদস্য ছিলেন এবং একজন সাহসী অধিবক্তা ছিলেন এলজিবিটিদের অধিকার আদায়ে, তথা মানবাধিকার আদায়ে"
সমকামিদের উৎসাহিত করার অভিযোগ ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বাংলাদেশে মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের কান্ট্রি অফিস খোলার প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ। এ নিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে ঢাকার ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে জেনেভা। সঙ্গে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনে সরকার গৃহীত সংস্কার কার্যক্রমে সহায়তার বিশাল প্যাকেজ অফার করা হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, তামিল বিদ্রোহের ছুতোয় শ্রীলঙ্কায় মানবাধিকারের কান্ট্রি অফিস খোলার প্রস্তাব ছিল জাতিসংঘের। এ নিয়ে ১০ বছর দেন-দরবার হয়েছে। কিন্তু কলম্বো কোনো চাপেই নতি স্বীকার করেনি। শ্রীলঙ্কায় ব্যর্থ চেষ্টার পর ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশে অফিস খোলার প্রস্তাব যায়। ট্র্যাক ওয়ান এবং ট্র্যাক টু- উভয় পন্থায় চলে দূতিয়ালি। কিন্তু না, কোনো দেশই অফিস খোলার স্থান দিতে রাজি হয়নি। তাই এবার টার্গেট বাংলাদেশ। আজ থেকে শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্কের ঢাকা সফর। হাই প্রোফাইল ওই সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য হতে যাচ্ছে ওএইচসিএইচআর’র ঢাকা অফিস খোলার বিষয়টি।
প্রধান উপদেষ্টা নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় সব উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতি, সেনাবাহিনী প্রধান এবং নাগরিক সমাজের বিভিন্ন স্তরে সিরিজ বৈঠক হবে ভলকারের। ভলকার তুর্ক গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য গঠিত ১০ কমিশন প্রধান এবং গুম কমিশনের সব সদস্যের সঙ্গে বসবেন একটি প্রাতঃরাশ বৈঠকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থীর সঙ্গেও মতবিনিময়ের পরিকল্পনা রয়েছে তার। জেনেভাস্থ অফিস অব দ্য ইউএন হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর) এর আনুষ্ঠানিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়- মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার তুর্ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন।
যেখানে তিনি সামপ্রতিক ছাত্র-আন্দোলনে সম্পৃক্ত প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। ঢাকায় জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং কূটনৈতিক মিশনগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলবেন। সফরের সমাপনীতে একটি সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিবেন। সংবাদ সম্মেলনটি উন্মুক্ত নয় বরং প্রবেশাধিকার রয়েছে এমন মিডিয়ার প্রতিনিধিরাই তাতে ঢুকতে পারবেন।
মানবাধিকার অফিসের কাজ এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ: ১৯৯৩ সালে জেনেভায় অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাই কমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস (ওএইচসিএইচআর)-এর কার্যক্রম শুরু হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১৭টি দেশে ওএইচসিএইচআর কান্ট্রি অফিস খুলতে পেরেছে। ব্যাংককসহ কিছু জায়গায় লিমিটেড স্কেলে তাদের রিজিওনাল অফিস রয়েছে। কান্ট্রি অফিস রয়েছে এমন দেশ হলো- বুরকিনা ফাসো, কম্বোডিয়া, চাদ, গুয়েতেমালা, গায়েনা, হন্ডুরাস, লাইবেরিয়া, মৌরিতানিয়া, মেঙিকো, নাইজার, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, সুদান, তিউনিসিয়া এবং ইয়েমেন।
দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ওএইচসিএইচআর-এর প্রস্তাবটি আত্মঘাতী। এটি গ্রহণ করলে এবং তাদের অফিস খোলার চুক্তি সই করলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের বড় ধরনের বিপদে পড়তে হবে। প্রথমত: এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলো বাংলাদেশের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ওএইচসিএইচআর-এর অফিস খোলার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে ৩৬ জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের পর থেকে স্বার্থান্বেষী নানা গোষ্ঠী সক্রিয়। ওএইচসিএইচআর-এর প্রস্তাব এসেছে ৫ই আগস্টের এক মাসের মাথায় এবং তা পারসু হচ্ছে নানাদিক থেকে। বাংলাদেশে জাতিগত কোনো সংঘাত হয়নি যে, এখানে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস খুলতে হবে- এমন মন্তব্য করে এক কর্মকর্তা বলেন, সংঘাতপ্রবণ দেশগুলোতে ওএইচসিএইচআর-এর অফিস রয়েছে। তাছাড়া ওই অফিসের বিরুদ্ধে দুনিয়ার দেশে দেশে সমকামিতার মতো সংবেদনশীল বিষয় প্রমোট করার অভিযোগ রয়েছে। সমকামিতা সব ধর্মে নিষিদ্ধ। অফিস খুলে এটি প্রমোশনের সুযোগ দিলে সরকার বাংলাদেশের সর্ব ধর্মের ধর্মভীরু মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়বে। ফলে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির এমন আশঙ্কাকে রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে দেখাটা সমীচীন বলে মনে করছে বাংলাদেশ।