ইতিহাসের আদি কাল থেকে আজ পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই কোনো কোনো দেশে সম্পদের প্রাচুর্য, আবার কোনো কোনো দেশে দারিদ্র্যের নিদারুণ কষাঘাত, অভাবের অপশাসন। কোনো কোনো দেশে হচ্ছে খাবারের নিদারুণ অপচয়, কোনো কোনো দেশে মানুষ না খেয়ে মরছে। অথচ এরকম তো হওয়ার কথা নয়। পৃথিবীতে মানুষ পাঠানোর আগেই স্রষ্টা মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান উপযুক্ত পরিমাণে তৈরি করে রাখেন। এখানে কোনো কিছুরই ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। কোনো কোনো বিশেষ দেশের জন্য প্রযোজ্য না হলেও বৈশ্বিক বিবেচনায় কথাটি ষোলো আনাই সত্যি। পৃথিবীর জনসংখ্যা বর্তমানে যদিও ৭০০ কোটি পার হয়েছে, হিসেব করলে দেখা যাবে সারা দুনিয়ায় এখনও যে খাদ্য ও অন্যান্য সম্পদ রয়েছে, তা পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য পর্যাপ্ত। মানবসন্তান শুধু একখানা মুখ নিয়েই জন্মায় না, সঙ্গে করে নিয়ে আসে মগজভর্তি একটি মাথা এবং কাজ করার জন্য একজোড়া করে হাত আর পা। আল্লাহ্র দেওয়া সম্পদ এবং জীবন বাঁচানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে সমঅধিকার বা জন্মগত অধিকার নিশ্চিত করা থাকলে যে কোনো মানুষ নিজের আহার নিজেই যোগাড় করে নিতে পারে। সম্পদের ওপর মানুষের সমঅধিকারটা নিশ্চিত করতে না পারাই হলো আসল প্রতিবন্ধকতা।
সৃষ্টিকর্তা মানবজাতিকে গোটা পৃথিবীর ওপর একচেটিয়া কর্তৃত্ব দিয়েছেন এবং সম্পদে সমান অধিকারও দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ নিজেই ডেকে এনেছে নিজের সর্বনাশ। মানুষ নিজেদের তৈরি কৃত্রিম সীমান্ত দিয়ে পৃথিবীকে ভাগ করেছে বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রে। তারপর জাতিসংঘ সনদ বানিয়ে সেটাকে করেছে ঐশীগ্রন্থের মত পবিত্র, অলঙ্ঘনীয়। এর ফলে কিছু কিছু দেশ শক্তি ও কূটকৌশল প্রয়োগ করে মানুষের জন্য নির্দিষ্ট করা সম্পদের একটা বড় অংশ নিজেদের কুক্ষিগত করে ফেলেছে এবং বাকিরা সম্পদের অভাবে হা হুতাশ করছে। তার আগে, প্রাচীন কালে অবশ্য পৃথিবীতে চালু ছিল অনেক জংলী নিয়ম। ন্যায়ভিত্তিক আইনকানুন কিছুই ছিল না। ‘জোর যার মুল্লুক তার,’ সেটাই ছিল সে সময়কার রেওয়াজ। তখন আধুনিক সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থাও ছিল না। যুদ্ধবাজ রাজা-বাদশাহগণ গায়ের জোরে পৃথিবীব্যাপী মানুষের সম্পদ হস্তগত করেছে। যুদ্ধে জিতে সবার জন্য নির্ধারিত সম্পদের ওপর নিজেদের একচেটিয়া দখল বিস্তার করেছে। অন্যকে সম্পূূর্ণ অনৈতিকভাবে বঞ্চিত করে অপচয় করেছে সে সম্পদের। জাতিসংঘের আবরণে আজও চলছে সে একই খেলা, একই লুণ্ঠন; তবে এখন তা একটু অন্যভাবে, একটু আড়ালে আবডালে।
পৃথিবীর সকল মানুষের উৎস যদিও এক ও অভিন্ন, তবুও তারা সাদা-কালো, ধনী-গরিব এবং ভিন্ন ভিন্ন জাতি-সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলো কীভাবে? প্রশ্নটির জবাব খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। মানুষকে তার সৃষ্টিকর্তা ভিন্নরূপে ও ভিন্নস্থানে সৃষ্টি করেছেন এবং তাদের রিজিকও বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছেন। যাতে তারা পরষ্পরকে আরো ঘনিষ্ঠভাবে চিনতে পারে, জানতে পারে, নিজেদেও মধ্যে সমম্বয় ঘটাতে পারে, ভাল কাজের পুরস্কার পেতে পারে এবং পরস্পরকে উপলব্ধি করতে পারে। এই ভিন্নতা বা বৈচিত্র্য সর্বক্ষেত্রে আছে এবং থাকবেও। বৈচিত্র্য আছে সৃষ্টিতে, প্রকৃতিতে, ধর্মে ও কর্মে। বৈচিত্র্য আছে খাদ্যাভাস, জীবনাচার, চিন্তা-চেতনা এবং কর্মের ফলাফল প্রাপ্তিতে। এই বৈচিত্র্য স্রষ্টা নিজেই সৃষ্টি করেছেন তার সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটন ও সত্যকে উপলব্ধি করার জন্য। মানুষে মানুষে ঝগড়া-মারামারি করার জন্য নয়, কে উত্তম, কে অধম এ নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য নয়। কিন্তু মানুষ নিজেদের নির্বুদ্ধিতার কারণে সে বিভিন্নতার সম্পূর্ণ উল্টো অর্থ বের করেছে। এই ভিন্নতার ওজর দেখিয়ে জাতিতে জাতিতে চলছে বিদ্বেষমূলক প্রতিযোগিতা, স্বার্থপরতা এবং যুদ্ধবিগ্রহের খেলা।
যে দেশে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা আছে, সে দেশের মানুষকে কৃত্রিম রাষ্ট্রীয় সীমান্ত দিয়ে আটকে রাখা যায় না। কোনো কালেই সেটা সম্ভব হয়নি, এখনো হচ্ছে না। ক্ষুধার নিবৃত্তি এবং উন্নত জীবনের সন্ধানে মানুষ আজ এক স্থান থেকে অন্যত্র চলে যাচ্ছে। আফ্রিকার তিউনিসিয়া থেকে ছোট ছোট নৌকো করে চলে যাচ্ছে ইউরোপের ইতালিতে। মেক্সিকো থেকে দুর্গম সীমান্ত পাড়ি দিয়ে শ্রমজীবী মানুষ জীবনবাজি রেখে চলে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে। পূর্ব ইউরোপের অভাবতাড়িত জনগোষ্ঠী অনবরত ছড়িয়ে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। বাংলাদেশ থেকে তরুণরা অভিনব পন্থায় চলে যাচ্ছে পূর্ব এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, যাচ্ছে আমেরিকাতেও। যাওয়ার পথে কেউ দুষ্টলোকের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কেউ বাক্সবন্দি লাশ হয়ে দেশে ফিরছে। কেউ থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে গণকবরে ঠাঁই পাচ্ছে, আবার কেউ পেট ভরে খেতে গিয়ে সাগরের নোনা পানিতে নিজেই কুমির আর হাঙ্গরের পেটের খাবার হয়ে যাচ্ছে। তবু তারা দমবার পাত্র নয়। জীবিকার খোঁজে অবিরাম ছুটছে দেশ থেকে দেশান্তরে।
মানুষের এই অদম্য চলার পথে সবচেয়ে বড় বাধা বিভিন্ন রাষ্ট্রের নানা নিয়মকানুন ও বাধ্যবাধকতা। মানুষের সৃষ্ট কৃত্রিম সীমান্তের কারণে মানুষ সহজে চলাফেরা করতে পারে না। আয়-উপার্জনের জন্য স্বাভাবিকভাবে এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে পারে না। সীমান্ত না থাকলে মানুষের এ অসুবিধা হতো না। ইদানিং এ অসুবিধা দূর হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সেনজেন ভিসা চালুর মাধ্যমে। কিন্তু ইউরোপের এই সাতাশটি দেশ তো আর পুরো পৃথিবী নয়। দুনিয়াটা আরও অনেক বড় এবং এর সমস্যাও অনেক বেশি জটিল ও গভীর। যেসব দেশ অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ এবং তুলনামূলকভাবে অল্প লোকসংখ্যা নিয়ে বিশাল ভূখণ্ডের মালিক হয়ে বসে আছে, তারা একদিকে দুনিয়াব্যাপী তাদের উৎপাদিত পণ্য ও পুঁজির অবাধ বিচরণ ও নিরাপত্তা চায়, আবার অন্যদিকে শ্রমশক্তি ও গণমানুষের আন্তর্দেশীয় অবাধ চলাচলকেও ভয় পায়। এ বৈপরীত্য এবং তার জটিলতা আর কেউ না হলেও সাম্প্রতিককালে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। এই অনাকাক্সিক্ষত মানবসৃষ্ট সীমানার অবসান হোক। মানুষ তাদের যোগ্যতা দিয়ে ছড়িয়ে পড়ুক সারা বিশে^. ভোগ করুক তাদের সমঅধিকার, এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. লোকমান হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমী (নায়েম), ঢাকা ।