নজিরবিহীন করোনাভাইরাস বৈশ্বিক ও স্থানীয় বাস্তবতায় অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। করোনার ছোবলে ওলটপালট পুরো শিক্ষা ক্যালেন্ডার ও বিপর্যস্ত শিক্ষা কার্যক্রম।
বিকল্প পদ্ধতিতে শিক্ষার এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০২০ সালের মার্চ থেকে চালু রয়েছে নানা কার্যক্রম। সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে; যেমন: স্বল্পমূল্যে ইন্টারনেট ডেটা প্যাক, ডিভাইস ক্রয়ের জন্য সফট লোন ইত্যাদির সঙ্গে সংসদ টেলিভিশন, বেতার, কমিউনিটি রেডিওর পাশাপাশি ভার্চুয়ালি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের নোটিশ শুধু আপডেট করে থাকতে হয়েছে। বৃহস্পতিবার (৬ মে) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত উপ-সম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপ-সম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ২০২১ সালের শুরুর দিকে করোনা সংক্রমণ কিছুটা কমায় সরকার ৩০ মার্চ স্কুল-কলেজ এবং ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলার একটি প্রস্তুতি নিতে প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের নির্দেশনা দেয়। তারপরই মার্চ থেকে বাড়তে থাকে সংক্রমণ, স্কুল-কলেজ খোলা সম্ভব হয়নি। ২৪ মে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা যাবে কি না, সেটিও অনিশ্চিত। আবার এতদিন ধরে করোনার গতি-প্রকৃতি ও সংক্রমণ বিষয়ে মানুষের যে ধারণা ছিল, সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তা অনেকটা ভিন্ন ধরনের, যা আমাদের করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলো নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ দিচ্ছে।
২. নানা উদ্যোগের মধ্যে করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের একটা অংশকে পাঠ্যক্রমের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা গেলেও একটা বড় অংশ এ কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। আমরা জানি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা, যাদের ইন্টারনেট সাপোর্ট, ডিভাইস (ল্যাপটপ, স্মার্টফোন ইত্যাদি) ও দুর্বল ইন্টারনেট গতির অসুবিধার কারণে সবাইকে সংযুক্ত করা যাচ্ছে না। অনেক শিক্ষার্থী এ প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত থাকায় শিক্ষকরা যথাযথ দিকনির্দেশনা ও সঠিক মূল্যায়নের দিকে যেতে পারছে না। আর বলতে গেলে, সে ধরনের নির্দেশনাও আপাতত নেই।
আমি নিজে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস নিয়ে থাকি। শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে ডেটা প্যাক ও ডিভাইস কেনার জন্য সফট লোন দেওয়া হলেও অবস্থার পরিবর্তন ও আশানুরূপ ফলাফল খুব একটা হয়েছে বলে মনে হয়নি। যারা অনলাইন ক্লাসে যুক্ত থাকছে, ইদানীং তাদের মাঝেও এক ধরনের উদাসীনতা ও হতাশার ছাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। করোনার আগেই চলা ও শুরুর অপেক্ষায় থাকা পরীক্ষাগুলো এবং ইতোমধ্যে অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শেষ হওয়া সেমিস্টারগুলো-কোনো পরীক্ষাই তারা দিতে পারেনি।
যদিও এ বছরের শুরুর দিকে, বিশেষ করে অনার্স ফাইনাল বা মাস্টার্স ফাইনাল চলমান পরীক্ষাগুলো নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল এবং বেশকিছু পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল, যা পরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক আবারও স্থগিত করা হয়। উপরন্তু করোনা সংকটে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর পারিবার আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ফলে উদ্বেগ আর টানাপোড়েনের মধ্যে অনলাইন লেখাপড়ায় মনস্থির করা তাদের জন্য এক দুরূহ ব্যাপার। শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিপর্যয়কর অবস্থা কবে কাটবে, কেউ তা বলতে পারছে না।
৩. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করোনা পরিস্থিতিতেও ইউজিসির সম্মতি নিয়ে শর্তসাপেক্ষে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা চালু রাখে। এতে করে গত বছর থেকে এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অন্তত ২-৩টি সেমিস্টার পার করে ফেলেছে। অন্যদিকে অনলাইনে ক্লাস মোটামুটি চালু থাকলেও পরীক্ষা না হওয়ায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একটি সেমিস্টারও পার করতে পারেনি। এক্ষেত্রে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
গত এক-দেড় বছরের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, করোনামুক্ত পৃথিবী কবে পাব, সেটি অনিশ্চিত। করোনাকে মৌসুমি রোগ ও বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ক্লাস, পরীক্ষা, মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে এখন থেকেই ভাবতে হবে। এ বছরের মাঝামাঝির দিকে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা ভর্তি হবে, যা বাড়তি চাপ তৈরি করবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরীক্ষা পদ্ধতি বা মূল্যায়নের বিষয়ে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার সমন্বিত কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি।
হয়তো অপেক্ষা করা হচ্ছিল করোনা সংক্রমণ কমলে প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষা ও মূল্যায়নের। সংক্রমণ আরও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার বাস্তবতা ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন শিক্ষার প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে অনলাইন পাঠদান আরও কার্যকর করতে হবে। এ রকম পাঠদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনবোধে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে। এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষকরাও নিজেদের প্রস্তুত করতে তৎপর হবেন।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গত বছর কিন্তু অনলাইন ক্লাসের সঙ্গে সঙ্গে তাদের স্ট্যান্ডার্ডে পরীক্ষা নিয়ে সেমিস্টারও শেষ করেছে। অন্যদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু আছে যেমন: অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুইজন পরীক্ষক এবং বিশেষ ক্ষেত্রে তিনজন পরীক্ষক দ্বারা খাতা মূল্যায়ন করতে হয়, যা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সেশনজটের একটি কারণও বটে। করোনা তাণ্ডবের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইতোমধ্যে সেশনজট নামক ভয়াবহ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে। এ থেকে মুক্তি পেতে হলে এখনই পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।
এমনকি করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট কমাতে হলে খাতা মূল্যায়নে দুই-পরীক্ষক পদ্ধতি পরিবর্তন করা প্রয়োজন। পৃথিবীর অন্য দেশগুলো প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা কীভাবে এগিয়ে নিচ্ছে সে বিষয়ে ধারণা নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করা যেতে পারে। এ মুহূর্তে যদি অনলাইনে পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করা কঠিন হয়, তাহলে বিকল্প উপায়ে অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম চালু রেখে শুধু পরীক্ষাগুলো ক্যাম্পাসে নেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে প্রয়োজনমাফিক শুধু পরীক্ষার্থীদের জন্য পরীক্ষা চলাকালীন সাময়িকভাবে আবাসিক হলগুলো খুলে দেওয়া যেতে পারে, যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব হয়।
তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সহযোগিতা ও দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে, যাতে গড়পড়তা সব শিক্ষার্থী হলে ওঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি না করে। একই সঙ্গে অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন পদ্ধতির জন্য সক্ষমতা অর্জনের প্রস্তুতি নিতে হবে। অন্যথায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।
সেশনজটের কারণে শিক্ষার্থীর ক্যারিয়ার ও চাকরিজীবনের প্রতিযোগিতায় অনেক প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। ফলে নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে যেমন: পড়ালেখার প্রতি অনীহা, হতাশাগ্রস্ত, উদ্যম ও আত্মবিশ্বাস হারিয়ে বিষণ্নতায় ভোগা। তাই সেশনজট নামক ভয়াবহ ব্যাধি রোধ করতে বা কমিয়ে আনতে আমাদের ছাত্র-শিক্ষক উভয়কে এগিয়ে আসতে হবে। উভয়কেই হতে হবে আন্তরিক ও যত্নশীল। এখনই বাস্তবতা বিবেচনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও ছাত্র-শিক্ষক সব মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থা সচল রাখার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক : ড. মো. খোরশেদ আলম, শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়