গণহত্যার দায়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। এই দলের অধীনে সর্বশেষ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গঠিত হয়েছে তিনটি সংসদ। এই ৩টি সংসদকেই আমরা অবৈধ মনে করি। আমরা একা কোনো সিদ্ধান্ত নেব না। সংলাপে অংশ নেওয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে, মতামত নিয়েই এই ৩টি সংসদকে অবৈধ ঘোষণা করার পন্থা নির্ধারণ করা হবে।
শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. মাহফুজ আলম এসব কথা বলেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম, উপসচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে গতকাল আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বেলা ৩টায় এ সংলাপ শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে শেষ হয়। এরপর এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী বলেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার মধ্যে সাতবার সামরিক শাসনসহ দলীয় সরকার ও পাঁচবার নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আর শেষ তিনটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শাসনামলে।
দশম সংসদ নির্বাচন
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে বিএনপি ও সমমনা অধিকাংশ দলই এ নির্বাচন বর্জন করে। তবে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রসহ ১৭টি দল নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসন জিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে। তবে বিরোধী জোট বর্জন করায় এই নির্বাচনটি বেশ বিতর্কিত ছিল। নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা বিজয়ী হওয়ায় নির্বাচনটি নিয়ে অনেক বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। ওই নির্বাচনে দেশের মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৯৭৭ ভোটারের মধ্যে ভোট দেওয়ার সুযোগ পান মাত্র ৪ কোটি ৩৯ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৮ জন। পরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গঠন করে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে। দশম জাতীয় সংসদে মোট ১৯৩টি বিল পাস হয়। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল অন্যতম। এ ছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, সড়ক পরিবহন আইন, সংবিধান সংশোধনী আইন, যৌতুক নিরোধ আইন, কওমি মাদ্রাসার সনদকে মাস্টার্সের সমমান করতে আইনসহ আলোচিত অনেক আইন পাস হয়।
একাদশ সংসদ নির্বাচন
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। এতে বাংলাদেশের বড় দুটি দল-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট জোটসহ নিবন্ধিত সর্বমোট ৩৬টি দল অংশগ্রহণ করে। ১ হাজার ৮৪৮ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। যার মধ্যে ১২৮ জন স্বতন্ত্র। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৫৬ আসন পায়। জাতীয় পার্টি ২২ আসন ও বিএনপি ৭টিতে জয়লাভ করে। নির্বাচনে সারা দেশে মোট ভোটার ছিলেন ১০ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ৪৮০ জন। এই সংসদ নির্বাচনে দেশে প্রথমবারের মতো ৬টি নির্বাচনি আসনে সম্পূর্ণভাবে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণ করা হয়। আসনগুলো হলো ঢাকা-৬, ঢাকা-১৩, চট্টগ্রাম-৯, রংপুর-৩, খুলনা-২ ও সাতক্ষীরা-২।
এদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের তৈরি প্রতিবেদনে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি বলে মন্তব্য করা হয়। তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ প্রতিবেদনকে একপেশে ও অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করেন।
একাদশ জাতীয় সংসদে আলোচিত 'সাইবার নিরাপত্তা বিল ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন বিলসহ মোট ১৬৫টি বিল পাস হয়। এ সংসদের শেষ অধিবেশনের সমাপ্তি দিনে বিল পাসে রেকর্ড সৃষ্টি হয়। এদিন সংসদের ইতিহাসে এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক ৭টি বিল পাস হয়েছিল।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন
চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষ কিংবা ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা থাকায় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। তবে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকারব্যবস্থার দাবিতে ইসির নিবন্ধিত ৪৪টি দলের মধ্যে বিএনপিসহ ১৭টি সমমনা দল এ নির্বাচনও বর্জন করে। তার পরও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ২৭টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ভোটে ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২৪টি আসন পেয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় পায়। ৬২টি আসনে বিজয়ী হন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। আর জাতীয় পার্টি জয় পায় ১১টি আসনে। অন্যান্য দল থেকে জয়ের মুখ দেখেছেন একজন করে প্রার্থী। ৯ জানুয়ারি নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ভোটের ফলাফলের গেজেট প্রকাশ করা হয়। গত ১০ জানুয়ারি জয়ী এমপিরা শপথ গ্রহণ করেন।
সর্বশেষ অনুষ্ঠিত এই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে শুরু থেকেই বিতর্ক ছিল। বিএনপিসহ ১৭টি দল ছাড়াই নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং ফলাফলও ছিল সম্পূর্ণ একপক্ষীয়। তখন থেকে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ফলাফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্নির্বাচনের দাবি তোলে। পরে জুলাই মাসে শুরু হওয়া ছাত্রদের কোটাবিরোধী আন্দোলন আগষ্টে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনে পরিণত হয়। এরপর ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দেশত্যাগের পর ৬ আগষ্ট রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে মাত্র ২০২ দিন ও ৪৭ কার্যদিবসে সমাপ্তি ঘটে দ্বাদশ সংসদের।