সরকারি-বেসরকারি স্কুলে বৈষম্য : সংখ্যালঘুদের ধর্মশিক্ষা ব্যাহত

ড. সাধন কুমার বিশ্বাস |

এক দেশ। এক শিক্ষাব্যবস্থা। একই কারিকুলাম-সিলেবাস। তবুও কতো বৈষম্য! বেতন স্কেল, প্রতিষ্ঠানের আয়-ব্যয়, পদসংখ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশের সরকারি ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনেক ফারাক। এসব বৈষম্যের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছেন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক ড. সাধন কুমার বিশ্বাস। তার সময়োপযোগী এই প্রতিবেদনের প্রথম কিস্তি ছাপা হলো আজ।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্টাফিং প্যাটার্নে লক্ষ্য করলে বেশ কয়েকটি বৈষম্য দেখা যায়। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (ধর্ম) পদে শুধু ইসলাম ধর্মের শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। ফলে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মের (হিন্দু-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ) শিক্ষার্থীদের স্ব স্ব ধর্মীয় বিষয় পড়ানোর জন্য কোনো শিক্ষক নেই।

অপরদিকে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের শিক্ষক আছেন। ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি ‘বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিদ্যালয়সমূহ) শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদির সরকারি অংশ প্রদান এবং জনবল কাঠামো সম্পর্কিত নীতিমালা’ সংশোধন করে বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ষাট জন একই ধর্মের শিক্ষার্থী আছে এমন ধর্মের একজন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের নির্দেশনা জারি করা হয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ আগস্ট জারি করা জনবল কাঠামোতে একই ধর্মের ন্যূনতম চল্লিশ জন শিক্ষার্থী এবং ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ জারি করা জনবল কাঠামোতে একই ধর্মের ন্যূনতম ত্রিশ জন শিক্ষার্থী থাকলে ঐ ধর্মের একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যাবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাধিক ধর্মের নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী থাকলে সংশ্লিষ্ট সব ধর্মের শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক একজন করে হিন্দু বা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায়। তবে, একই ধর্মে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায় না।

বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অবিলম্বে হিন্দু বা খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষার সহকারী শিক্ষক পদ সৃজন করা খুবই জরুরি। বাংলাদেশে বর্তমান সরকারের আমলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একমাত্র ইসলাম ধর্মের শিক্ষক ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের শিক্ষক না থাকা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় বৈষম্য। 

এদিকে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের স্টাফিং প্যাটার্ন ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জনবল কাঠামো লক্ষ্য করলে আরও দেখা যায়,

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভূগোল বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদ থাকলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভূগোল বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদ নেই। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদ থাকলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদ নেই।

অপরদিকে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক ও কম্পিউটার ল্যাব অপারেটরের পদ থাকলেও সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ের সহকারী শিক্ষক ও কম্পিউটার ল্যাব অপারেটর পদ দুটি নেই।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে আগে সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগারের কোনো পদ ছিল না। ফলে, সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এ পদে কোন সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার নেই। তবে, সর্বশেষ ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ আগস্টে জারি করা নিয়োগবিধিতে এ পদটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদিও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার পদটি ছিল। কিন্তু সে বছরের ২৮ মার্চ জারি করা জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় এ পদটি গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক নামে পরিবর্তিত হয়েছে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষাধারার পাশাপাশি ভোকেশনাল কোর্স চালু করার লক্ষ্যে সেসিপ প্রোগ্রামের আওতায় ইতোমধ্যে ২০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ ৫৪৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভোকেশনাল কোর্স চালু হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের সব মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ কোর্স চালু করার লক্ষ্যে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় প্রত্যেক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ট্রেড ইন্সট্রাক্টর ও  ট্রেড অ্যাসিসট্যান্টের দুটি করে পদ সৃজন করা হয়েছে। নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে ওই পদে নিয়োগও দিয়েছে। কিন্তু সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এখনও পর্যন্ত এ পদ দুটি সৃজন করা হয় নি।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উচ্চমান সহকারী ও অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক নামে তৃতীয় শ্রেণির দুটি কর্মচারী পদ থাকলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অফিস সহকারী-কাম-হিসাব সহকারী নামে তৃতীয় শ্রেণির মাত্র একটি পদ আছে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অফিস সহায়ক, নিরাপত্তা প্রহরী, মালী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নামে চার ধরনের চতুর্থ শ্রেণির পাঁচটি কর্মচারী পদ আছে। কিন্তু সরকারি স্কুলে দুইজন অফিস সহায়ক নিয়োগ পান। অপরদিকে  বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও অফিস সহায়ক, নিরাপত্তাকর্মী, নৈশপ্রহরী, পরিচ্ছতাকর্মী ও আয়া (সহশিক্ষা ও বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য) নামে চতুর্থ শ্রেণির পাঁচটি কর্মচারী পদ রয়েছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘সহশিক্ষা’ ও ‘বালিকা’ বিদ্যালয়ে ‘আয়া’ পদ থাকলেও সরকারি স্কুলে তা নেই। অথচ, বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহশিক্ষা চালু রয়েছে, বালিকা বিদ্যালয়ও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। অথচ সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘আয়া’ পদে চতুর্থ শ্রেণির কোনো কর্মচারী না থাকায় যথেষ্ট অসুবিধা হচ্ছে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অবিলম্বে একটি ‘আয়া’ পদ সৃজন করা প্রয়োজন।

সরকারি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শুধু পদের ক্যাটাগরি নিয়েই নয়, শিক্ষক পদসংখ্যা নিয়েও বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলার সহকারী শিক্ষক ও ইংরেজির সহকারী শিক্ষক পদে চারজন করে শিক্ষক থাকলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বাংলার সহকারী শিক্ষক ও ইংরেজির সহকারী শিক্ষক পদে আছে মাত্র একজন করে শিক্ষক। অবশ্য সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রতি শিফটে রয়েছে অন্তত দুইটি শাখা। অপরদিকে, বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একটি অতিরিক্ত শাখা খোলা হলে একটি পদ বৃদ্ধি পায়। বেসরকারি স্কুলে একটি শাখা খোলা হলে বাংলা,ইংরেজি, গণিত, সামাজিক বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান, ধর্ম, শারীরিক শিক্ষা,কৃষি শিক্ষা বিষয়ের মধ্যে যেকোন একটি বিষয়ে মাত্র একজন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া যায়)।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ের সহকারী শিক্ষকের ৩টি পদ থাকলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গণিতের সহকারী শিক্ষক পদ মাত্র একটি। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক, ব্যবসায় শিক্ষা বিষয়ের সহকারী শিক্ষক , ভৌতবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক, জীববিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষকের দুইটি করে পদ থাকলেও বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এসব বিষয়ের জন্য মাত্র একজন শিক্ষকের পদ আছে।

সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্ম বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদে শুধু ইসলাম ধর্মের দুইটি শিক্ষক পদ আছে। কিস্তু বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কোনো ধর্মের ন্যূনতম ৩০জন শিক্ষার্থী থাকলে, সে ধর্মের জন্য একজন করে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ করা যায়। অর্থাৎ কোনো বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যদি ইসলাম ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম ও খ্রিস্টান ধর্মের পৃথক পৃথক ন্যূনতম ৩০জন করে শিক্ষার্থী আছে, সেই বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সেসব ধর্মের জন্য মোট চারজন পর্যন্ত সহকারী শিক্ষক নিয়োগ দেয়া সম্ভব। (চলবে)


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059349536895752