দেশের মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা নানামুখী সঙ্কটের মধ্য দিয়ে চলছে, যদিও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা শিক্ষা বিভাগের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো তা স্বীকার করতে চাইছে না। তারা যখন যেটি করছে সেটাকেই অতি উত্তম ভাবছেন। শিক্ষাবিদ ও অভিভাবকদের আপত্তি উপেক্ষা করে শিক্ষা বিভাগের কর্তাব্যক্তিরা পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ওপর বার্ষিক পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে শিক্ষার্থীদের কতটা লাভ বা ক্ষতি হয়েছে সে নিয়ে কোন গবেষণা বা গভীর পর্যবেক্ষণ নেই। অতি সম্প্রতি সরকার পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে পাবলিক পরীক্ষা বাদ দিলেও পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা রেখে দিয়েছে, যার ফল প্রকাশ নিয়ে এবার কেলেঙ্কারিও হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষা নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক-স্বল্পতা, সময়মতো শিক্ষার্থীদের হাতে পাঠ্যবই না পৌঁছানো, বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম না থাকা- শিক্ষার্থীদের ‘ভাগ্যলিখন’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার প্রস্তাব কয়েকবারই করা হয়েছিলো। সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ এ এটি করার প্রস্তাব করা হয়েছিলো- কিন্ত করা হয়নি।
জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ মতে প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং প্রশিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। এমনকি তৎকালীন শিক্ষক প্রশিক্ষণের প্রচলিত ব্যবস্থাকে অপ্রতুল, চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত এবং যুগোপযোগী নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো। যার ফলে তৎকালীন ৫৩টি সরকারি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট থেকে সরকারের উদ্যোগে আরও ১৪টি প্রাইমারি ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট বেড়ে বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকদের পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য সারা দেশে ৬৭টি সরকারি প্রাইমারি টিচার্স ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট রয়েছে। একই সঙ্গে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে পিটিআইগুলোতে যতো প্রশিক্ষক ছিলেন, বর্তমানে তাদের দ্বিগুণেরও বেশি প্রশিক্ষক, প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচেছন। এ ছাড়া সহকারি সুপারিনটেনডেন্টের আরও একটি নতুন পদ ২০২০-এ সৃষ্টি করা হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে সব পিটিআইতে দুইজন করে সহকারি সুপারিনটেনডেন্ট কাজ করে যাচেছন। তাই পিটিআইগুলোতে আগের চেয়ে গতিশীলতা এসেছে। এটি আনন্দের সংবাদ। সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষ জানুয়ারি ২০২০ থেকে জুন ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে ডিপিএডের আওতায় ১৯ হাজার ৯৪৩ জন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে ২০১২ থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মোট ৭৮ হাজার ৭৯৬ জন শিক্ষককে ১৮ মাসব্যাপী ডিপিএড কার্যক্রমের আওতায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এগুলো প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে খুবই আনন্দের সংবাদ হলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণগত দুর্বলতা আর দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ নজর না দেয়ার বিষয়টি থেকেই যাচেছ।
প্রাথমিক শিক্ষায় আর একটি বিষয় সংশ্লিষ্টরা হয়তো সেভাবে কেউ লক্ষ্য করছেন না। বিষয়টি হচ্ছে দেশের ১৪৫টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সংযুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে যদিও সেই স্তরে পাঠদানের জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই। শত শত উদাহরণের মধ্যে এই একটিমাত্র উদাহরণই যদি আমরা ধরি, তাহলে বোঝা যায় আমাদের শিক্ষা কতোটা অব্যবস্থাপনা, কতোটা পরিকল্পনাহীন এবং কতোটা অবহেলিত অবস্থার মধ্যে পড়ে আছে। আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মাধ্যমিকের শিক্ষা মন্ত্রণালয় পুরোপুরি আলাদা। তাহলে একই প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিকের কয়েকটি ক্লাস বাকিগুলো মাধ্যমিকের। শিক্ষা প্রশাসনের তো সমস্যা হওয়ারই কথা। যেহেতু বিষয়টি শিক্ষার তাই এ নিয়ে তেমন কারো উচ্যবাচ্য নেই। বাচ্চাদের পড়িয়ে দিলেই বা কি আর না দিলেই বা কি ! সবাই তো কোচিং করছে। দ্বিতীয়ত, এসব সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আলাদা কোন শিক্ষক নেই। প্রাথমিকের প্রশিক্ষণবিহীন শিক্ষকরা কি প্রাথমিকে ফ্রুটফুল কোন টিচিং দিতে পারবেন? অবশ্যই না। চাইল্ড সাইকোলজি আলাদা বিষয়। তাদের পড়ানোর টেকনিকও আলাদা।
একজন শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণি থেকে একটি ক্লাস নিয়ে পরের ক্লাস নবম কিংবা দশম শ্রেণিতে নিতে হয়। হঠাৎ করে শ্রেণিকক্ষের এবং বয়সভেদে শিক্ষাদানের পরিবর্তন ঘটে তার একটি নেগেটিভ প্রভাবও আছে। এর মধ্যে ১০টি বিদ্যালয়ে উচ্চমাধ্যমিকও (একাদশ ও দ্বাদশ) চালু আছে। এসব বিদ্যালয়ে যারা শিক্ষক হয়ে আসেন তারা সবাই মাধ্যমিক স্তরের। দুই স্তরের পাঠদান পদ্ধতিতে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, এসব মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কীভাবে প্রাথমিক শিক্ষা যুক্ত হলো তা তারা জানেন না। এ বিষয়ে মাউশিতে কোন নথিপত্রও নেই। কি আজব কাণ্ড ! ঢাকা ও ঢাকার বাইরে অবস্থিত বেশ কয়েকটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মাউশির কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন, বর্তমানে যেভাবে এ শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, তা কোনভাবেই ভালো নয়। এভাবে মানসম্মত শিক্ষা সম্ভবও নয়।
সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের প্রাথমিক স্তরে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। মাধ্যমিক স্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাথমিক স্তরে যে ভালো পড়ানো যায় না, সেটা শিক্ষা বিভাগের, অভিভাবকদের বুঝতে হবে। একইভাবে দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতি বাড়তি মনোযোগ দিতে হবে শ্রেণিকক্ষেই। শ্রেণিকক্ষের বাইরে কোচিং ও নোট-গাইড ব্যবসাকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাক্ষেত্রে দুই মন্ত্রণালয় কিংবা অধিদপ্তরের যে দ্বৈত শাসন চলছে তারও অবসান ঘটাতে হবে। শিক্ষার্থীদের যারা পড়াবেন, তাদের মানসম্মত প্রশিক্ষণের বিষয়টি কোনভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। শিক্ষার দুটি মন্ত্রণালয় রাখা খুব একটা যুক্তিযুক্ত নয়।
মন্ত্রণালয় থাকলেই যে কোনো বিষয়ের প্রতি বেশি নজর পড়বে তা কিন্তু নয়। আমাদের দেশে মন্ত্রণালয় বাড়ালেই আমরা হাততালি দিতে থাকি যে, বিষয়টির প্রতি রাষ্ট্র খুব মনোযোগ দিয়েছে। তাতে যে খরচ বাড়ছে আর আমলাতন্ত্রিকতা বাড়ছে সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি না। গোটা মার্কিন যুক্তরষ্ট্রে মাত্র ১৫টি মন্ত্রণালয় আর আমদের মতো ছোট ও দরিদ্র দেশে ৩৮টি। এ এক ধরনের অপচয় ছাড়া আর কিছুই না। যদি প্রাথমিক শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাস একটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে থাকে সেটি কিন্তু সহজেই সম্ভব যদি একটি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থাকে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিকভাবেও বিষয়টি সাশ্রয়ী। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকা মানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আলাদা কোনো প্রধান শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার ধারাবাহিকতা বুঝতে পারেন। তবে, সে রকম ব্যবস্থা থাকতে হবে।
একটি সংবাদে দেখলাম, দেশে প্রতি দুই কিলোমিটারের মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকলে সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। সেজন্য নতুন করে আবেদন নিচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। ১ হাজার ৫০০ বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চলতি বছরের ১৮মে পর্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আবেদন করার কথা ছিলো। ওদিকে দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো এত অপরিকল্পিতভাবে স্থাপিত হয়েছে যে, কোথাও কোথাও দশজনের নীচে শিক্ষার্থী আছে আবার কোথায় ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার শিক্ষার্থীও আছে। এর মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। আবার এগারো ধরণের তথ্য দিয়ে এ আবেদন করতে হবে। এর মধ্যে উপজেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটির কার্যবিবরণী, উপজেলা পর্যায়ে গঠিত কমিটির সুপারিশ । প্রাথমিক স্কুলের দূরত্ব ও ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা, প্রস্তাবিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবস্থান, দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন স্কুল না থাকলে সেক্ষেত্রে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা বা অন্য কোন বিষয় থাকলে তা উল্লেখ করতে হবে।
প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের গ্রামে কোন স্কুল আছে কিনা, নিজস্ব জমি আছে কিনা, না থাকলে বিকল্প প্রস্তাব কী হবে, জমি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা, জমি থাকলে তা বিদ্যালয় করার মতো উপযোগী কিনা, এসব তথ্যও দিতে হবে। প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ের মৌজার সংখ্যা কত এবং ক্যাচমেন্ট এলাকায় প্রাথমিক স্কুলে ভর্তিযোগ্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত (বয়স ৫ থেকে ১১ বছর) এসব তথ্য দিয়ে উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তা অধিদপ্তরে পাঠাতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয় কি স্থানের দূরত্বে নাকি জনসংখ্যার অনুপাতে হবে সেই বিষয়টিতে জোর দেয়া প্রয়োজন। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংষ্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর গত জানুয়ারিতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে ব্যয়ের ৭১ শতাংশই বহন করতে হচেছ পরিবারগুলোকে। এতে এ সত্যই বেরিয়ে এসেছে যে, সরকার শিক্ষা নিয়ে ঢাকঢোল পেটালেও এ খাতে রাষ্ট্রীয় অবদান খুব বেশি নয়। শিক্ষাব্যয়ের সিংহভাগই বহন করতে হয় অভিভাবককে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দের হার কম। প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রেড তিনবার পরিবর্তন হয়েছে, অতএব দশম গ্রেডে নেয়ার প্রস্তাব আর প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো যাবে না বলে প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে। অন্যান্য পেশায় ১৬তম গ্রেড থেকে এক লাফে ১০ম গ্রেডে পৌঁছে যায় অথচ প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড তিনবার পরিবর্তন হয়েও ১৩তম থেকে যায়। বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে।
শিক্ষার উন্নয়নের সামগ্রিক চিত্র অবলোকন করতে গেলে প্রথম দৃষ্টি দিতে হবে প্রাথমিক শিক্ষার দিকে। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে অনেকেই একসঙ্গে কাজ করছেন। কিন্তু মূল হচেছ ‘প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী’। সদ্য স্বাধীন দেশে সঙ্গত কারণেই প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের মেধা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে নজর দেয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু একটু একটু করে এগিয়ে যাওয়া আর ধাপে ধাপে উন্নয়নের সিঁড়ি অতিক্রম করা দেশে শুধু এসএসসি পাস থাকেনি প্রাথমিক শিক্ষকরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষধাপ অতিক্রম করা শিক্ষার্থীরা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষাগত যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ, উন্নত দেশের শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণসহ নানা দিক দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষকরা আজ অনেক পরিণত এবং দক্ষ। তবে, এই সংখ্যাটি একেবারে কম। শিক্ষক হিসেবে, ইংলিশ টিচার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা একটি এনজিও-র প্রধান হিসেবে বহু প্রাথমিক শিক্ষকদের সাথে ওঠা-বসা, আলাপ-আলোচনা, কথাবার্তা হচ্ছে এবং অনেক প্রোগ্রামে তাদের দেখছি। আশার কথা যে, সেই পুরনো দিনের ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে থাকা শিক্ষকদের জায়গায় ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা তরুণ শিক্ষার্থীরা এই পেশায় প্রবেশ করছেন। তাদের মধ্যে অনেকের পারফরম্যান্স সত্যিই আনন্দদায়ক।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক