সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ইচ্ছামতো ভর্তি ফি আদায়

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিসহ অন্যান্য ফির ক্ষেত্রে সমতা নেই। একেক কলেজ এমবিবিএস প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একেক রকম ভর্তি ফি নিচ্ছে। এমনকি বছরজুড়ে কলেজভেদে পরীক্ষা ফিসহ অন্যান্য ফিও একেক রকম। বিশেষ করে ঢাকার সঙ্গে দেশের অন্যান্য জেলার এবং পুরনো মেডিক্যাল কলেজগুলোর সঙ্গে নতুন মেডিক্যাল কলেজের ফির বৈষম্য অনেক বেশি। ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরের একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে একজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি হতে সর্বোচ্চ তিন গুণ ও গড়ে দেড় থেকে দুই গুণের বেশি অর্থ গুনতে হচ্ছে। ঢাকায় সর্বনিম্ন ভর্তি ফি ১০ হাজার ও ঢাকার বাইরে সর্বোচ্চ ৩২ হাজার টাকা। এমনকি ঢাকায় গড়ে যেখানে ভর্তি ফি ১০ হাজার থেকে সাড়ে ১৫ হাজার টাকা; সেখানে ঢাকার বাইরে এই ফি গড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা।

এমনকি বার্ষিক পরীক্ষাসহ অন্যান্য ফিতে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ভিন্নতা রয়েছে। ঢাকায় যেখানে বছরে এই ফি নেওয়া হয় ৫-৬ হাজার টাকা; সেখানে ঢাকার বাইরে ১৪-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ফি দিতে হয় শিক্ষার্থীদের।

কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পুরনো মেডিক্যাল কলেজ পরিচালনায় সরকারের বরাদ্দ বাজেট নতুন মেডিক্যাল কলেজের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে কলেজ পরিচালনায় এসব কলেজ কর্র্তৃপক্ষকে বাধ্য হয়ে বেশি ফি নিতে হয়। গত বছর দেশের ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজে যাতে সমান ভর্তি ফি নেওয়া হয়, সে জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে আলোচনা হয়েছিল। সে সময় কলেজ কর্র্তৃপক্ষ তাদের নানা সমস্যার কথা বলেছিল। যেমন ছাত্রাবাস নেই, বাড়ি ভাড়া করে শিক্ষার্থী রাখতে হয়। এ কারণে ১৫ হাজার ৩০০ টাকা করেছিল সব কলেজে। কিন্তু তা কেউ মানেনি। গত বছরও ভর্তি ফি ছিল লাগামহীন। ২৫-৩৩ হাজার পর্যন্ত নিয়েছে।

ঢাকায় সরকারি মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে চারটি। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি ১০ হাজার টাকা করে। এরপর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি নেওয়া হচ্ছে ১১ হাজার ৫০০ ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজে ১৫ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে।

এ ব্যাপারে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. এ বি এম মাকসুদুল আলম বলেন, ‘এখানে আসন ২০০। পরে বিদেশি আরও ২০ জনের মতো ভর্তি হয়। সব মিলে ২২০ জন ভর্তি হয়। ঢাকা মেডিক্যাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজে আসন ২৩০টি করে। ফলে ওই দুই কলেজে ১০ হাজার টাকা করে ভর্তি ফি। আমাদের এখানে একটু বেশি।’

সরকারি ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে চারটি ঢাকায়। এই চারটি বাদে দেশের বাকি সব কলেজে ভর্তি ও অন্যান্য ফি ঢাকার তুলনায় সর্বোচ্চ তিন গুণ এবং গড়ে দ্বিগুণের বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিক্যাল কলেজে। এখানে শিক্ষার্থীদের থেকে ভর্তি ফি নেওয়া হচ্ছে ৩২ হাজার টাকা। আগামী ৪ ও ৫ এপ্রিল ভর্তির তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে কলেজ অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, গত বছর ভর্তি ফি ২০ হাজার টাকার মতো ছিল। একেক কলেজে একেক রকম ভর্তি ফি। ছোট কলেজগুলোতে ছাত্র কম, সেখানে একটু বেশি। বড় মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র বেশি, সেখানে ভর্তি ফি একটু কম হয়। ছোট মেডিক্যাল ৫০-৫২টি আসন ও বড় কলেজে ২৩০টির মতো।

একই কলেজের ইন্টার্নশিপের এক শিক্ষার্থী জানান, ২০১৭ সালে ভর্তি ফি ছিল ১৮ হাজার টাকা। ছয় মাস পরপর ২ হাজার ১০০ টাকা দিতেন পরীক্ষার ফির জন্য।

এরপর সর্বোচ্চ ভর্তি ফি নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিক্যাল কলেজে, ২৫ হাজার টাকা। মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি ২৩ হাজার টাকার একটু বেশি। রংপুর, নীলফামারী, বগুড়া ও পাবনা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি নেওয়া হচ্ছে প্রায় ২০ হাজার টাকা করে।

দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি ১৮ হাজার ৯০০ টাকা। কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৫০০ টাকা ভর্তি ফি ও ৩ হাজার টাকা হোস্টেল উন্নয়ন ফি। নেত্রকোনা মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি ফি ১৭ হাজার টাকা। ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি ফি ১৫ হাজার ৩০০ টাকা। গত বছর ছিল ১২ হাজার ২০০ টাকা।

কলেজ অধ্যক্ষরা জানিয়েছেন, যেসব কলেজ নতুন হয়েছে, আসন কম, সেসব কলেজে ফি বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ এই ফির টাকা দিয়ে তাদের কলেজ পরিচালনার ব্যয় মেটাতে হয় এবং শিক্ষার্থীদের হোস্টেল সুবিধা ও হোস্টেলে খাওয়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিতে হয়; বিশেষ করে এর মধ্যে যেসব কলেজ নতুন, সেগুলোর জন্য সরকারি বরাদ্দ এখনো পর্যাপ্ত নয়।

রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের চতুর্থ বর্ষের এক শিক্ষার্থী জানান, তারা ২০১৮ সালে ভর্তি হয়েছেন। তখন ভর্তি ফি ছিল ১০ হাজার টাকা। মাসে মাসে কোনো টিউশন ফি নেই। তবে প্রতি বছর ফাইনাল পরীক্ষার (ইয়ার চেঞ্জ) সময় ৬-৭ হাজার টাকা লাগে। হোস্টেলে খাওয়ার খরচ নিজেদের। খাওয়া ও বইপত্র কিনতে ৭ হাজারসহ মাসে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়।

কিন্তু ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তাদের বছরে পরীক্ষাসহ অন্যান্য ফি ঢাকার চেয়ে দ্বিগুণ বেশি। প্রতি বছর চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে পরীক্ষা ও কলেজ ফি বাবদ তাদের ১৫-১৬ হাজার টাকা দিতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারটি প্রফেশনাল পরীক্ষা হয়। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৩-৪ হাজার টাকা ফি নির্ধারণ করে। প্রতি বছর কলেজের খেলাধুলা, পরিচয়পত্র, কারিকুলাম, ছাত্র কল্যাণ, অভ্যন্তরীণ পরীক্ষা, ধর্মসংক্রান্ত মসজিদ ফি, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সমাবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে ফি নেওয়া হয়। প্রতিটি সাবজেক্টের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ৮-৯ হাজার টাকা নেয়। তবে এই ফি ঢাকায় অনেক কম। ঢাকার বাইরে বেশি।

মানিকগঞ্জের কর্নেল মালেক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, এ বছর বিভিন্ন খরচ বেড়েছে। শিক্ষার্থী কম। এর মধ্যে চেষ্টা করি দরিদ্র ছাত্রছাত্রী থাকলে, তাদের বিভিন্ন ফি মওকুফ করে দিতে হয়।

নোয়াখালী আব্দুল মালেক উকিল মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আব্দুস সালাম বলেন, ভর্তি ফি নির্ধারণ হয় কলেজের একাডেমি কাউন্সিলের সভায়। যে কলেজগুলোতে ছাত্রসংখ্যা বেশি, সেই কলেজগুলোতে টাকার পরিমাণ কম। আর তুলনামূলকভাবে যেসব কলেজে ছাত্রসংখ্যা কম, সেখানে ফি বেশি। কারণ সারা বছরের খরচ একবারে নেওয়া হয়।

 ঢাকার বাইরের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে প্রতি বছরের ফাইনাল প্রুফ পরীক্ষার ফি ঢাকা ও পুরনো মেডিক্যাল কলেজের তুলনায় অনেক বেশি। কোনো কোনো কলেজে এই ফি দ্বিগুণ বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

কলেজভেদে ফির এমন ভিন্নতার কথা স্বীকার করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মো. জামাল। তিনি বলেন, কলেজগুলোকে এ বছর আগের বছরের মতোই ফি নিতে বলা হয়েছে। কলেজভেদে ফি ভিন্ন। কারণ একেক কলেজ একেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।

সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন অফিসের ফি থাকে। যে কলেজে ছাত্র সংসদ আছে, তারা এর জন্য ফি নেয়। কোনো কোনো কলেজ হোস্টেল ফি, কমনরুম চার্জ নেয়। সবকিছু মিলে ১৫-২০ হাজারের মধ্যেই ভর্তি ফি থাকে।

এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মোটামুটি একটা নির্দেশনা দিই। তবে সেটা চূড়ান্ত কিছু নয়। আমরা ফি সমন্বয়ের চেষ্টা করেছিলাম। মেডিক্যাল কলেজগুলোর সঙ্গে অনেক ধরনের ও সংখ্যার বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিল আছে। এগুলো সমন্বয় করতে গেলে বৃহত্তরভাবে আলোচনা করে সমন্বয় করতে হবে।’

গত ২৭ মার্চ থেকে দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তি শুরু হয়েছে। চলবে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত। এ বছর সরকারি ও বেসরকারি ১০৮টি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে পারবেন ১১ হাজার ১২২ জন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৪ হাজার ৩৫০ এবং ৭১টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ৬ হাজার ৭৭২ আসন রয়েছে। এ ছাড়া মেরিট লিস্টের বাইরে জেলা কোটায় ৮৪৮, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৮৭ ও উপজাতি কোটায় ৩১ শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পাবেন। ৬ এপ্রিল ভর্তি শেষ হওয়ার পর কলেজ কর্র্তৃপক্ষ কোন কলেজে কয়টি আসন খালি আছে, সেই তালিকা স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠাবে। পরে সেই তালিকা অনুযায়ী কলেজ পরিবর্তনের সুযোগ পাবেন শিক্ষার্থীরা।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029878616333008