ঈদ, পূজা, বড়দিন ইত্যাদি ধর্মীয় উৎসবগুলো পালন করে স্ব স্ব ধর্মের মানুষ। এসব ধর্মীয় উৎসবে একত্রে সকল মানুষের মিলন ঘটে না। কিন্তু বাংলা নববর্ষ এমন একটি উৎসব যেখানে সকল ধর্মের বর্ণের মানুষের মিলন ঘটে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে সকল মানুষ উৎসবে মেতে ওঠে বাংলা নববর্ষে। এটি বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। মানুষ হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে অনাবিল আনন্দে মেতে উঠে। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে নতুন রঙিন পোশাকে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে।
বাংলা নববর্ষ শুধুমাত্র উৎসবের দিন নয়- শপথেরও দিন। পুরাতন ক্লেষ আর জরাজীর্ণকে পিছনে ফেলে নতুন আশায়, নতুন শপথে নব উদ্যোমে মানুষ আবার জীবন শুরু করে। দিন যত যাচ্ছে এই উৎসবের সর্বজনীনতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অতীতে আজকের দিনের মত এমনভাবে দিনটি পালিত হতো না। দোকানদার বা ব্যবসায়ীরা হালখাতা করত। পুরাতন খাতা বাদ দিয়ে নতুন খাতায় হিসাব শুরু করতো। কোনো কোনো পরিবার হয়ত বিশেষ খাবারের ব্যবস্থা করতো। হিন্দু ধর্মাবল্মীরা পূজা অর্চনা করতো। কিন্তু বর্তমান সময়ে পুরো জাতি উৎসবে মেতে ওঠে। রাস্তায় রাস্তায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এতোসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিনটিকে উৎসবে পরিণত করাই যেন লক্ষ্য। আর সেই লক্ষ্যকে সর্বজনীন করার পেছনে বাংলাদেশের অন্যতম সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের ভূ’মিকা অনস্বীকার্য।
ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে প্রতিবাদে ছায়ানট ঢাকার রমনা বটমূলে ১ বৈশাখের প্রভাতে প্রতিবাদী রবীন্দ্র সংগীত দিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু করে।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ঢাকার রমনা বটমূলে ১ বৈশাখের প্রথম সুর্যোদয়ের সাথে সাথে সংগীতানুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণের শুভ সূচনা। সেই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত আছে। দিন দিন এর কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু মাত্র ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে অনুষ্ঠান হতে পারেনি। আর ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠান চলাকালে জঙ্গীদের বোমা হামলায় অনুষ্ঠানটি পন্ড হয়ে যায়। তবে জঙ্গীদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি। সারাদেশের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো প্রতিবাদে ফেটে পড়ে এবং বর্ষবরণের অনুষ্ঠান দেশব্যাপি বিস্তার লাভ করে। ছায়ানটও থেমে থাকে নি। প্রতি বছর, বছরের প্রথম প্রহরে ছায়ানটের এই অনুষ্ঠান আজ কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ছায়ানটের পরই নববর্ষের বড় আকর্ষন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাহারি রঙের পোষাক আর মুখোশ পরে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে নেচে গেয়ে তারা বর্ষকে বরণ করে। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বৈশাখী মেলা বসে। এই মেলায় রকমারি কারুপণ্যের সম্ভার দেখা যায়। এছাড়া সারাদেশে অসংখ্য মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এসব মেলায় রকমারি দেশীয় পণ্যসহ পুতুল নাচ, বায়োস্কোপ, লাঠিখেলা ইত্যাদির আয়োজন হয়ে থাকে। কোনো কোনো জায়গায় নৌকা বাইচও অনুষ্ঠিত হয়। ঘরে ঘরে রকমারি সুস্বাদু খাবার আয়োজনসহ ঐতিহ্যবাহী পান্তা-ইলিশের ব্যবস্থা হয়ে থাকে প্রায় সব জায়গায়। এই দিনে দুঃখের গ্লানি কাউকে স্পর্শ করে না। প্রত্যেকেই খুশির মেজাজে থাকে।
হাতেগোনা কতিপয় পশ্চাদপদ মৌলবাদী বাঙালির চিরায়ত সর্বজনীন এই উৎসকে পছন্দ করেন না। তাই তারা অঘটন ঘটানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। যেমনটি করেছিল ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে রমনা বটমূলে ছায়ানটের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে। কিন্তু অজেয় অদম্য বাঙালি দমে যায় নি। তারা দ্বিগুন উৎসাহে বর্ষ বরণের আয়োজনে মেতে উঠে। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাদ্দের ৫ নভেম্বর সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের সময়কাল থেকে ফসলি সন হিসেবে যে বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছিল কালের বিবর্তনে এখন তা বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। যে উৎসব হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান সকল জাতিকে একই সূত্রে গ্রোত্থিত করেছে। এ বন্ধন অবিচ্ছেদ্য। সামন্ত প্রভূ ও দাসেদের মাঝে গড়ে ওঠা রক্তাক্ত এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। আজও ইতিহাস সে কথাই বলছে।
লেখক : সন্তোষ দাস, প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, ফকিরহাট