সর্বজনীন পেনশন বাংলাদেশকে আরেক ধাপ এগিয়ে নিলো। দেশে এখনো পর্যন্ত শুধু সরকারি লোকেরাই পেনশন পান। কিন্তু, সবারই বৃদ্ধ বয়সে আয় কমে যায় বা থাকে না। কিন্তু চিকিৎসা খরচ বাড়ে। খাবার-দাবারে নানা বিধি-নিষেধ আসে। তাই খাবারের খরচ বাড়ে। বৃদ্ধদের একটা বড় অংশ অচল অবস্থায় চলে যান।
এখন দেশের ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে ৬০ শতাংশ মানুষ বয়স্ক ভাতা পান। এটা একটা অসাধারণ সাপোর্ট। অভিজ্ঞতায় দেখেছি এখনো বৃদ্ধ মানুষেরা বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া পছন্দ করেন না। সেখানে সর্বস্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগ নেই। অন্য সব সুযোগ থাকলেও মনের চাহিদা মেটে না।
আমার জানা মতে, বৃদ্ধদের একজন শুভাকাঙ্ক্ষী একটা বৃদ্ধাশ্রম করেছেন ঢাকার অতি সন্নিকটে, ধামরাইয়ে। তিনি সেখানে থাকার লোক পাচ্ছেন না। আমাদের অবশ্যই সামাজিক-সংস্কৃতির বিষয়টি ভাবনায় এনে বৃদ্ধদের শুভ কামনা করতে হবে। বৃদ্ধদের হাতে কিছু টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে পরিবারেই তাদের গুরুত্ব বাড়বে। সেখানেই তারা বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন।
সরকারের সর্বজনীন পেনশন একটি অসাধারণ পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি। বিশেষ করে পৃথিবীর এই মন্দার সময়ে এমন একটা উদ্যোগ প্রশংসনীয়। সবে শুরু এটা। একসময় বিশাল মহীরুহ হবে চিকিৎসায়, শিক্ষায়, প্রশিক্ষণে। বয়স্কদের জন্য উপযুক্ত কাজ সৃষ্টিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।
এ কথা বলে রাখা মনে হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না, পেনশন বিধি ও আইনকে প্রথম দিকে অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার জন্য সংশোধন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন করার জন্য মুক্তমন নিয়ে কর্তৃপক্ষকে কাজ করতে হবে।
১. ভালো আইনে বিস্তারিত থাকে না: আইন অনমনীয়, সহজে পরিবর্তন করা যায় না। তাই আইনে সবকিছুই বিস্তারিত থাকা ভালো আইনের লক্ষণ না।
২. বিধিতে বিস্তারিত থাকে: চিন্তা ভাবনা করে কর্মশালা করে, কাল বিলম্ব না করে পেনশন কর্তৃপক্ষ বিধি প্রণয়ন করতে পারে।
৩. সর্বজনীন পেনশনের পূর্বসূরি বয়স্ক ভাতা: সরকার ইতোমধ্যেই সর্বজনীন পেনশনের প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপন করেছে, বয়স্ক ভাতা তার একটি অন্যতম উদাহরণ। সরকার প্রায় ৮৪০ কোটি টাকা এ খাতে প্রতিবছর ব্যয় করছে। দেশের ৬৫ বছরের বেশি বয়সের ষাট শতাংশ মানুষ এর আওতায় এসেছেন।
৪. জীবন বিমা চাপে পড়বে: জীবন বিমার সঙ্গে এর একটি প্রতিযোগিতা শুরু হবে। যারা বিমার টাকা দিতে গড়িমসি করে, তাদের জন্য ব্যবসা ভালো যাবে না।
৫. বেসরকারি চাকরিজীবীদের নিরাপত্তা সৃষ্টি হলো: যারা বেসরকারি চাকরি করেন তাদের পেনশনের ব্যবস্থা নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরির বয়স বেশি হলে বেতন বেড়ে যায়। তাই তাদেরকে নানা ছল ছুতোয় ছাঁটাই করে দেওয়া হয়। এ পেনশন ব্যবস্থা আশা করছি মালিকদেরকে বাধ্য করবে পেনশনের চাঁদা দেওয়ার জন্য। কিছু না হলেও তাৎক্ষণিকভাবে বেসরকারি চাকরি করার বিরাট একটা জনগোষ্ঠীর জন্য পরবর্তী জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে।
৬. সরকার এখনো সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা: এখানে প্রবাসী থেকে শুরু করে গ্রামের সাধারণ মানুষও পেনশনের জন্য চাঁদা দেবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
৭. কীভাবে ব্যবস্থাপনা হবে: আমি মনে করি, পেনশন কর্তৃপক্ষের প্রথম কাজ হবে একটা ডিজিটাল সিস্টেম তৈরি করা। সেটার ট্রায়াল দেয়া ও ভুল সংশোধন করা। কোনো নতুন সিস্টেম কখনোই চাহিদানুযায়ী সেবা দিতে পারে না। ডিজিটাল সিস্টেম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং ভবিষ্যৎবাণী করার জন্য উত্তম মিডিয়াম।
৮. সরকারের কোনো অবদান থাকবে কি না: আমরা আশা করি, বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সরকারি অবদানের প্রয়োজন হবে না। কিন্তু যারা এর বাইরে তাদের জন্য সরকারি অবদানের দরকার হবে। বিশ্বাস করি, যারা বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন এই পেনশনের পাশাপাশি সেটিও চালু থাকবে অতি দরিদ্রদের জন্য। কারণ, এখনো অনেকের হয়তো কন্ট্রিবিউশন করার ক্ষমতা নেই। সরকারের সক্ষমতা বেড়েছে, তাই সরকারের জন্য এটা অসম্ভব নয়। পেনশন কর্তৃপক্ষ যদি হিসাব-কিতাব করে এর পরিসর বাড়ায় তবে কোনো বেগ পেতে হবে বলে আমি মনে করছি না।
৯. বৃদ্ধদের চিকিৎসা: বাংলাদেশে প্রবাদ আছে- বসতে দিলে শুতে চায়। এই পেনশন চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি দেখতে পাই, আগামী দিনগুলোতে আমাদের প্রতিটি হাসপাতালে জেরিয়াটিক বা বৃদ্ধদের জন্য ইউনিট তৈরি হচ্ছে। বৃদ্ধদের জন্য স্পেশালিস্ট আলাদা হাসপাতাল হলে তাতে আমি অবাক হবো না।
১০. সরকার সক্ষম হতে পারবে: সরকারের কর্তৃপক্ষের কাছে এ পেনশনের চাঁদার বিশাল তহবিল থাকবে। তাই এই তহবিলের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা নিয়ে ভাবার কিছু নেই। অপরপক্ষে, এই তহবিল থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ নিতে পারবে। সুতরাং ঋণের আরেকটি সুযোগ বাড়লো।
আমি এই স্কিমে সরকার বা যারা কন্ট্রিবিউট করবেন তাদের জন্য কোনো ঝুঁকি দেখছি না। সম্ভাবনার একটা বিরাট দিগন্ত উন্মোচিত হবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, মানবিকতা, প্রযুক্তি ও অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ আমাদের কাছ থেকে শিখবে।
লেখক : মো. নজরুল ইসলাম খান, সাবেক শিক্ষাসচিব