সর্বাগ্রে সন্তানের নিরাপত্তা

সন্তোষ দাস |

ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সেদিন এক ভদ্রলোক সরকারের সমালোচনা করে বলছিলেন, ‘সরকার দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একেবারে ধ্বংস করে দিল।’ আমি জিজ্ঞাসু নেত্রে তার দিকে তাকালাম। তিনি আরও বললেন, ‘এক বছরের বেশি সময় ধরে স্কুল-কলেজ বন্ধ। ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার বারটা বেজে গেল না?’ আমি বললাম, ‘স্কুল- কলেজতো শুধু আমাদের দেশেই বন্ধ নয়, আমাদের পাশের দেশসহ, পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বন্ধ। কি বলবেন?’ ভদ্রলোক এ প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারলেন না।

আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’

এবার আমি ঠান্ডামাথায় তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘অনেস্টলি বলেনতো, এই মুহূর্তে স্কুল খুলে দিলে আপনি কি আপনার সন্তানকে পাঠাবেন?’ ভদ্রলোক এবার প্রবলবেগে দুই দিকে মাথা নেড়ে বললেন, ‘কখনো না, কখনো না। আগে সন্তানের নিরাপত্তা। এক বছর স্কুলে না গেলে যে ক্ষতি হবে, তা এক সময় পুষিয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু ওর জীবনের নিরাপত্তা আগে।’ 

এবার আমি মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনার সন্তানের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাকে স্কুলে পাঠাবেন না। তাহলে আপনি কেন চাইছেন সরকার স্কুল-কলেজ খুলে দিক?’ এই প্রশ্নে ভদ্রলোক একটু থমকে গেলেন। তিনি যথার্থ উত্তর দিতে পারলেন। 

তিনি উচ্চ শিক্ষিত এবং একটি বেসরকারি সংস্থায় উচ্চপদে কর্মরত। যিনি স্কুল কলেজ বন্ধ রাখার জন্য সরকারের সমালোচনা করছেন, তিনি আবার নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর প্রশ্নে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেলেন। স্ববিরোধিতা আর কাকে বলে! এই ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার পর আমি কৌতুহলী হয়ে ব্যক্তিগতভাবে আরও কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বললাম, যাদের স্কুল-কলেজ পড়ুয়া সন্তান রয়েছে। এদের অধিকাংশই একই ধরণের মানসিকতা পোষণ করেন। অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতির বর্তমান পর্যায়ে স্কুল কলেজ খুললেও তারা তাদের সন্তানদের পাঠাবেন না। তাদের কাছে নিজ সন্তানদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সর্বাগ্রে। কিন্তু মজার ব্যাপারটি হলো এরাই বিভিন্ন আড্ডায় বসে স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার জন্য সরকারের সমালোচনায় মুখর।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
 
আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে বা কোন সংস্থা যদি অভিভাবকদের মতামত নেন, তাহলে মোটামুটি এই ধরণেরই চিত্র পাবেন। অর্থাৎ তারা চাইছেন সরকার স্কুল কলেজ খুলে দিক। কিন্তু তিনি নিজে তার সন্তানকে পাঠাবেন না। ভাবখানা এমন, যে পাঠানোর পাঠাক। যদি কোন শিক্ষার্থীর ভালমন্দ কিছু হয়, তখন আবার সরকারকে এক হাত দেখে নেওয়ার সুযোগ পাওয়া যাবে। তখন তারা সরকারের কঠোর সমালোচনায় মেতে উঠবে। শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অভিযোগে তারা সরকারকে অভিযুক্ত করবে। নিজেরা স্বাস্থ্যবিধি মানবে না, অথচ করোনায় আক্রান্ত হলে যেন দায়টা সরকারের ঘাড়ে চাপাতে পারলে স্বস্তি। আমরা প্রতি পদক্ষেপে কিছু মানুষের কাছ থেকে এমন স্ববিরোধী আচরণ লক্ষ্য করে থাকি।

আর একটা জায়গায় স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যাচ্ছে। অভিভাবকরা বলছেন, এই মুহূর্তে স্কুল খুললেও সন্তানের নিরাপত্তা বিবেচনায় তারা তাদের স্কুলে পাঠাবেন না। কিন্তু তারা তাদের সন্তানদের ব্যাচ বা কোচিং এ কিন্তু ঠিকই পাঠাচ্ছেন, বিশেষ করে শহরে। আমি খুলনা শহরে গত ১ জুন থেকে দলে দলে ছেলেমেয়েদের ব্যাচ বা কোচিং এ যেতে বা আসতে দেখছি। এসব ব্যাচ-কোচিংয়ের পরিচালকরা যেন সরকারের সাথে লুকোচুরি খেলছেন। সরকারি নজরদারী কঠোর হলে তারা কিছুদিন বন্ধ রাখেন, আবার সুযোগ পেলেই কোচিং খুলে দেন। অভিভাবকদের কাছে ফোন করে তাদের সন্তানদের পাঠাতে বলেন। অভিভাবকরাও অবলিলায় পাঠান। অবশ্যই সবাই নন।

স্কুল কলেজে যদিওবা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাস করা সম্ভব, ব্যাচ-কোচিংয়ে এটা একেবারেই সম্ভব নয়। সেখানে শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট রুমে গাদাগাদি করে বসে। স্কুল-কলেজ নিরাপদ নয়, অথচ ব্যাচ-কোচিং নিরাপদ! এমনই অদ্ভুত আমাদের মানসিকতা। 

আমাদের দেশে টিকা দেয়া শুরু হলে, এক শ্রেণির মানুষের কাছ থেকে এমন স্ববিরোধী আচরণ আমরা দেখেছি।  টিকা নিয়ে অপপ্রচার করা হয়েছে, মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমরা যখন মানুষকে টিকা নিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছি, তখন তারা টিকার বিরুদ্ধে নানা প্রকার নেতিবাচক কথা বলেছে। এ টিকায় কাজ হয় না, বড় বড় নেতারা নেয় না কেন? ইত্যাদি প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। আবার এখন যখন টিকা নিয়ে সংকট দেখা দিয়েছে তখন উল্টো সমালোচনা করছে। বলছে, সরকার মানুষের টিকা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ টিকার সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনায় পার্শ্ববর্তী ভারতের চেয়ে আমারা অনেক এগিয়ে। 

ভারতীয় টিভির খবরে টিকা প্রদানে অব্যবস্থাপনার চিত্র আমরা দেখেছি।  ‘আগে এলে আগে পাবেন’ নীতিতে টিকা নিতে গিয়ে মানুষ স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে ঠেলাঠেলি করে গায়ে গা লাগিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে টিকা পাচ্ছে না। দ্বিতীয় ডোজ কারা পাবে, তার হিসাব পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। কারণ প্রথম ডোজ কারা নিয়েছে তার পরিসংখ্যন তারা রাখেনি। 

কিন্তু আমাদের এখানে আমরা অনলাইনে নিবন্ধন করে, আগে থেকে মোবাইলে মেসেজ পেয়ে, নির্দিষ্ট দিনে টিকা কেন্দ্রে গিয়ে কোন প্রকার হয়রানি ছাড়া টিকা গ্রহণ করতে পারছি। প্রথম ডোজ গ্রহণকারীরা নির্ধারিত সময় পর দ্বিতীয় ডোজের জন্য মেসেজ পাচ্ছেন। দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণের পর আমরা সনদপত্রও দেয়া হচ্ছে। আমাদের দেশে টিকা প্রদানের এই সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা কিন্তু সমালোচকদের চোখে পড়ছে না!

সরকার প্রধান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই বুঝতে পারছেন, দীর্ঘদিন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় লেখাপড়ার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি সবাই আবার স্বীকার করছেন, সর্বাগ্রে জীবন। বেঁচে থাকাই প্রথম কথা। সন্তানের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোন অভিভাবকই আপোষ করতে চান না। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায় এই মুহূর্তে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও উপস্থিতির হার হবে নগন্য। সুতরাং অযৌতিক সমালোচনা না করে, পরিস্থিতি অনুধাবন করে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই উচিত। 

এখন দীর্ঘদিন গৃহবন্দি শিক্ষার্থীদের জন্য যা করা যেতে পারে, যতদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হচ্ছে, যতদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না খুলছে ততদিন, বিশেষ করে স্কুল কলেজের শিশু কিশোর শিক্ষার্থীদের বাবা-মা বা অভিভাবককে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যে যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায়, তা কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যেগে সন্তানের লেখাপড়া চালিয়ে নিতে হবে। পাঠ্যবই পড়তে পড়তে শিশু কিশোররা একঘেয়েমী বা বিরক্তি বোধ করলে, ওদের উপযোগী অন্যান্য বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সৃজনশীল বা বিনোদনমূলক কাজ যেমন-গান-বাজনা, নৃত্য, চিত্রাঙ্কন, ঘরোয়া খেলাধূলা ইত্যাদিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে। এখন এই করোনাকালে বিভিন্ন সংস্থা বা সংগঠন অনলাইনভিত্তিক পরীক্ষা এবং কুইজসহ নানা প্রকার প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে, যাদের প্রযুক্তিগত সুবিধা আছে, অর্থাৎ স্মার্ট ফোন এবং ইন্টারনেট সুবিধা আছে তারা এগুলোতে অংশগ্রহণ করে একঘেয়েমী বা মানসিক অবসাদ দূর করতে পারেন।

অভিভাবকদের উচিত নয় শিশুদের সামনে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা বা নেতিবাচক কথা বলে তাদের শিশু মন বিষিয়ে দেওয়া। বরং উৎসাহ ও অনুপ্রেরণামূলক বার্তার মাধ্যমে তারা যাতে বিদ্যমান পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করাই উচিত। শেষ কথা, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে করোনা প্রতিরোধে সকলকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। 

লেখক : সন্তোষ দাস, প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ, ফকিরহাট, বাগেরহাট


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024929046630859