বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাংবাদিক কামাল লোহানীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন। সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
কামাল লোহানী ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন তৎকালীন পাবনা জেলার (বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলা) সোনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী ও মাতা রোকেয়া খান লোহানী। তার আসল নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। কামাল প্রথমে কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে পড়াশুনা শুরু করেন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে পাবনায় চলে আসেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন।
কামাল লোহানী ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষা আন্দোলনে জড়িত হন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এডওয়ার্ড কলেজে নুরুল আমিন ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতাদের আগমনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের এক প্রতিবাদী বিক্ষোভে অংশ নেয়ার কারণে গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং অনেকের সঙ্গে পুনরায় গ্রেপ্তার হন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কারাবাস করেন। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইতে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে ঢাকা চলে আসেন এবং মার্ক্সবাদের সঙ্গে জড়িত হন। এ সময় তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির রাজনীতি করতেন। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের সামরিক শাসনের সময় অনেকর সঙ্গে আত্মগোপন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সদস্য ছিলেন।
কামাল লোহানী ঢাকায় আসার পর চাচাত ভাই ফজলে লোহানীর সহায়তায় ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় যোগদানের মাধ্যমে সাংবাদিকতা শুরু করেন। এরপর দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকার কর্মরত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুদফায় যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক জনপদ নামক একটি পত্রিকাতে যোগদানের মাধ্যমে পুনরায় সাংবাদিকতা পেশায় ফিরে আসেন। তিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবার্তা, এরপর দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় সাংবাদিকতা করে ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার নির্বাহী সম্পাদক ও ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধের ফলে দৈনিক বার্তা ছেড়ে দেন এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ১৬ মাস মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর তিনি পুনরায় বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে চলে আসেন। ২০০৯ থেকে ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পুনরায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন। তিনি চার বছর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে নবনাট্য সংঘ নামে পদক্ষেপ ধর্মী নাট্য দল তৈরি করেন যা দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা ছিলেন। কামাল লোহানী ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেণ।