সাংবাদিক মিজান প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

সাংবাদিক মিজানুর রহমান খানের মৃত্যুতে আমি বিস্ময়ে বিহ্বল হয়েছি। কারণ, আমরা সাধারণত ভাবি যে আমাদের পরিচিত মানুষেরা যিনি যেখানে আছেন, ভালো আছেন। কিন্তু আসলে বিষয়টা সে রকম নয়। আর সৌভাগ্যক্রমে সমমনা মানুষদের দেখা পাওয়া এবং দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁদের হারিয়ে ফেলা—দুটোই মানবজীবনের এক গভীর রহস্য।

মিজানুর রহমান খানের সঙ্গে আমার পরিচয় দীর্ঘদিনের নয়; আমাদের মধ্যে যে খুব ভালো জানাশোনা ছিল, তা–ও নয়। কিন্তু আমরা পরস্পরের সঙ্গে ‘যুক্ত’ ছিলাম। বছর দুয়েক আগে ঢাকায় আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে; আমাদের উভয়েরই ভাবনার বিষয় ছিল রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা। তারপর থেকে মাঝেমধ্যে ই–মেইলের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ হতো। আমরা নিজেদের ভাবনা ও মতামত বিনিময় করতাম; তিনি প্রথম আলোর জন্য আমার লেখা চাইতেন; তিনি আমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। লেখা ও সাক্ষাৎকারের বিষয় ছিল মূলত গণহত্যা কনভেনশন। আর একটা ভাবনা ছিল, কী করে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইজেসি) পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়। তাঁর প্রশ্নগুলো হতো সুনির্দিষ্ট; আমার কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট উত্তরই তিনি পাওয়ার চেষ্টা করতেন, যেন আমার কথাগুলো তাঁর কাছে এবং প্রথম আলোর পাঠকদের কাছে পরিষ্কারভাবে বোধগম্য হয়। আমার সাক্ষাৎকার তিনি বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন, যেন বাংলাদেশের ভেতরে এবং বাইরে বৃহত্তর ও বিচিত্র পাঠকদের কাছে তা পৌঁছায়। আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন নির্ভরযোগ্য পেশাদার সাংবাদিক, আইনের প্রতি যাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল। বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ন্যায়বিচার সম্পর্কে তাঁর বোধ ছিল স্বচ্ছ ও তীক্ষ্ণ।

আজ থেকে এক বছর আগে আমি একটি একাডেমিক কনফারেন্সে যোগ দিতে এবং রোহিঙ্গা সমস্যার হালনাগাদ অবস্থা জানার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে আবার ঢাকা গিয়েছিলাম। তত দিনে আইজেসিতে মামলাটি একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়েছিল এবং সেই আদালত অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি কক্সবাজারের কাছে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে যাই, তাদের সঙ্গে কিছু সময় কাটাই, আইজেসির রায়ের বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া শুনি।

তারপর ঢাকা ফিরে প্রথম আলোর আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিই। এই পুরোটা সময় মিজানের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল; তিনি সোনারগাঁও হোটেলে এসে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন; আমাকে সঙ্গে নিয়ে হেঁটে প্রথম আলোর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। তখনো তিনি বরাবরের মতোই আমার প্রতি মনোযোগী ছিলেন; রোহিঙ্গাদের বিষয়ে তাঁর আন্তরিক আগ্রহ ছিল অটুট। আমি খোলা মনে আমার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে জানিয়েছিলাম।

এখন ভাবলে আমার মনে হয়, তিনি যাঁদের সাক্ষাৎকার নিতেন, তাঁদের মনের কথা জানার জন্য নিজের মনের কথাও অকপটে প্রকাশ করতেন, যেন সাক্ষাৎকারদাতা কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, অকপটে নিজের কথাগুলো বলেন। তিনি মোক্ষম কথাগুলোই বলতেন, আর তা শুনে আমিও কথা বলতে উৎসাহ বোধ করতাম। তাঁর সারল্য আর অমায়িক সৌজন্য লক্ষ করে আমার মনে হতো, তাঁকে মনের সব কথা খুলে বলা যায়। সাংবাদিকতা পেশার প্রতি তাঁর আন্তরিকতা ও সততার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনের কথা বলা বাহুল্য।

আমার দুর্ভাগ্য, কোভিড–১৯ মহামারির কারণে গত বছরের বাকিটা সময় আমি আর বাংলাদেশে যেতে পারিনি। আর এখন জানলাম, এই ভয়ংকর ভাইরাস এক সুন্দর হৃদয়ের মানুষকে পৃথিবী থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী তাদের এক সুহৃদ বন্ধুকে হারাল। ন্যায়ের আদর্শ এক বন্ধুকে হারাল। আর বাংলাদেশ হারাল সাংবাদিক সমাজের এক অগ্রগণ্য সদস্যকে। পৃথিবীজুড়ে সাংবাদিকতা যখন প্রবল চাপের মুখে পড়েছে, সেই সময়ে মিজানুর রহমান খানের প্রস্থান সাংবাদিকতা পেশার জন্য এক বিরাট ক্ষতির বিষয়।

আমার বিশ্বাস, মিজান তাঁর চারপাশের অনেক মানুষের কাছে প্রেরণার উৎস হয়েছেন; বিশেষত পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তিনি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন। আমি তাঁকে যতটা দেখেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁরা দেখেছেন, জেনেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল এ জন্য আমি সম্মানিত বোধ করি। তাঁকে যেটুকু দেখেছি, জেনেছি, তা–ই আমার জন্য সম্মানের বিষয়, আনন্দের বিষয়। মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা যে পাশাপাশি কিছুটা পথ হেঁটেছি, এটাও আমার জন্য সম্মান ও সুখের বিষয়।

আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

ইংরেজি থেকে ভাষান্তরিত

লেখক : জন প্যাকার, কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ইন্টারন্যাশনাল কনফ্লিক্ট রেজল্যুশন বিষয়ের অধ্যাপক এবং একই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রাইটস রিসার্চ অ্যান্ড এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক

সূত্র : প্রথম আলো


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026400089263916