সাংসদ পাপুল দম্পতির বহিষ্কারই সমাধান, বলেছিলেন মিজানুর রহমান খান

নিজস্ব প্রতিবেদক |

কুয়েতে বিচারাধীন সাংসদ শহিদুল ইসলাম ওরফে পাপুল এবং তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলামের সাংসদ থাকার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নির্ধারণের বিষয় মূলত সংসদের। এ মুহূর্তে এটা আদালতের হাতে থাকার কথা নয়।

২ কোটি ৩১ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১৪৮ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় শহিদের বাংলাদেশে থাকা স্ত্রী, শ্যালিকা জেসমিন প্রধান ও মেয়ে ওয়াফা ইসলাম আগাম জামিনের জন্য আবেদন করেছেন। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশ কী করবে? কুয়েতের আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? প্রশ্নটি রাজনৈতিক, রাজনৈতিক এবং রাজনৈতিক।

এমনকি কুয়েতের আদালতে শহিদ যদি কমপক্ষে দুই বছর দণ্ডিত হন, তাহলেও তা আপনাআপনি কার্যকর হবে না। কারণ, তখন তর্কের বিষয় হবে বিদেশি আদালতে দণ্ড দিলে সেটা বাংলাদেশের ওপর বর্তায় কি না। এমনকি কেউ হয়তো বলবেন, যদি এ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয় যে বিদেশি আদালতে দণ্ডিত হলেই বাংলাদেশ কারও সদস্যপদ খারিজ করলে সেটা একটা মন্দ নজির স্থাপন হবে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এতে খর্ব হবে কি না, সেই প্রশ্নও কেউ কেউ তুলতে পারেন।

আসলে বিষয়টি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করে। এর মানদণ্ড বিচার বিভাগের হাতে নেই। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা মানব এবং অর্থ পাচারের অভিযোগকে কীভাবে দেখে, তার ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।

দুদক নিজেই তদন্ত চালিয়ে টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে। সেই প্রমাণের ভিত্তিতে তারা মামলা করেছে। সেই মামলায় তারা আদালত থেকে সাংসদ দম্পতির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করাতে পেরেছে। সুতরাং সংসদের সামনে অনেক বড় প্রশ্ন হলো, সংসদ কাকে বিশ্বাস করবে? দুদকসহ বাংলাদেশি অন্যান্য সংস্থাকে, নাকি তারা কুয়েতের আদালতের রায়ের অপেক্ষায় থাকবে। অপেক্ষা আবার দুই রকমের। কুয়েতি আদালতে কী ঘটে, সেটার শেষ পরিণতি দেখা এবং বাংলাদেশের বিচার বিভাগের শেষ ফলাফল কী ঘটে, সেটা দেখা। অথচ এ দুটি অবস্থার কোনোটিই বাংলাদেশের সংবিধান এবং ব্রিটেন, ভারতীয়সহ কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সংসদীয় রীতিনীতি সমর্থন করে না। রীতি যেটা সমর্থন করে সেটা হলো কালবিলম্ব না করে সাংসদ দম্পতির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা। সংসদের এথিকস কমিটি যদি অভিযোগের ব্যাপারে নিশ্চিত হয় তবে সংসদের অবমাননার জন্য তাঁদের বহিষ্কার করা।

আমরা দেখে আসছি যে বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের দিকে না তাকিয়ে সচেতন মহলের অনেকেই ৬৬ অনুচ্ছেদের দিকে দৃষ্টি দেন। ৭৮ অনুচ্ছেদের আওতায় স্পিকারকে বিচার বিভাগীয় এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। এ এখতিয়ারের ফলে স্পিকার কোনো নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে যেকোনো সাংসদের ‘যোগ্যতা’ পরখ করার এখতিয়ার রাখেন। স্পিকার সাংসদকে সাময়িক বরখাস্ত বা বহিষ্কার করতে পারেন। এ জন্য তাঁকে অন্য কোনো সংস্থার মুখাপেক্ষী বা কারও চূড়ান্ত রায় বা সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। এমনকি স্পিকারকে সর্বোচ্চ আদালতের মুখাপেক্ষী থাকতে হবে না। সংসদ অবশ্যই ৬৬ অনুচ্ছেদ এবং ৭৮ অনুচ্ছেদ মিলিয়ে দেখতে পারে। ৬৬ অনুচ্ছেদে সাংসদ থাকার যোগ্যতার যে তালিকা আছে, সেই একই তালিকা ভারতের সংবিধানেও আছে। প্রতিবেশী ভারতের সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ এবং বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৮ অনুচ্ছেদের মধ্য মিল রয়েছে। মিলটা হলো, প্রিভিলেজ কী, তার লঙ্ঘন কী, সেটা সংসদ নির্দিষ্ট করবে। দুদকের তদন্ত সঠিক হলে সাংসদ দম্পতি অবশ্যই প্রিভিলেজ লঙ্ঘন করেছেন।

ভারতে অর্থের বিনিময়ে সংসদে প্রশ্ন তোলার দায়ে ২০০৬ সালে ১১ সাংসদ (১০ জন লোকসভার, ১ রাজ্যসভার) বহিষ্কৃত হন। একটি টিভি চ্যানেলের স্টিং অপারেশনে (ছদ্মবেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা) দেখা যায়, ওই সাংসদেরা অর্থ নিয়েছিলেন। বহিষ্কৃত সাংসদেরা তখন এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। তাঁরা যুক্তি দেন যে সংবিধানের প্রিভিলেজ–সংক্রান্ত ১০৫ অনুচ্ছেদ নির্দিষ্টভাবে সাংসদকে বহিষ্কারের এখতিয়ার দেয়নি। আক্ষরিক অর্থে কথাটি অসত্য নয়। কিন্তু আগেই বলেছি, বিষয়টি রীতিনীতি–সংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ সংবিধানের ৭৮(৫) অনুচ্ছেদটি বলেছে, ‘এই অনুচ্ছেদ-সাপেক্ষে সংসদের আইন দ্বারা সংসদের, সংসদের কমিটিসমূহের এবং সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার নির্ধারণ করা যাবে।’ কিছু সাংসদ যা করছেন, তাতে এ আইন তৈরি করা সময়ের দাবি।

ভারতে ওই ১১ জন বহিষ্কৃত সাংসদের মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গোটা বিষয়টি নিরঙ্কুশভাবে হাউস অব কমন্সের নজিরের আলোকে বিচার করেন। এবং রায় দেন যে কোনো সাংসদের ‘যোগ্যতা’ যাচাই করে পদক্ষেপ নেওয়ার এখতিয়ার স্পিকার সংরক্ষণ করেন। কারও বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির এখতিয়ার স্পিকারের আছে এবং সেখানে কোনো ভুলভ্রান্তির জন্য তিনি কোনো আদালতে জবাবদিহি করবেন না।

রাজা রাম পাল বনাম স্পিকার, লোকসভা মামলায় সুপ্রিম কোর্ট সাফ বলেছেন, সংসদ তার মর্যাদা রক্ষায় অবশ্যই তার সদস্যদের বহিষ্কার করতে পারে। অন্যতম রায়দানকারী বিচারপতি ঠাক্কারের একটি মন্তব্য প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম তাঁর বইয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে সমর্থন করেছেন। এবং বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে সাংসদ শহিদ–সেলিনা দম্পতিকে দ্রুত বহিষ্কার করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা উচিত।

২০১৬ সালের এপ্রিলে রাজ্যসভার এথিকস কমিটির সিদ্ধান্তে শহিদের চেয়েও বড় শিল্পপতি বিজয় মালিয়াকে রাজ্যসভা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। ভারতের যে এথিকস কমিটি বিজয়ের বিরুদ্ধে বহিষ্কারের সুপারিশ করেছিল, তার থেকে শহিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক গুরুতর। বিজয় টানা ১০ বছর তাঁর সম্পদ ও দায়ের বিবরণীতে কোনো পরিবর্তন দেখাননি। এর ভিত্তিতেই বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্যসভা। তারা আদালতের দিকে তাকানোর নীতি নেয়নি।

রাজ্যসভা সদস্যদের জন্য বার্ষিক সম্পদ ও দেনার বিবরণী প্রকাশ করা বাধ্যতামূলক। কমিটির সদস্যরা কোনো আদালতের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে নিজেদের চোখ ব্যথা হতে দেওয়ার বিকল্প বেছে নেননি। বরং নিজেরাই তাঁদের ক্ষমতাবলে ব্যাংকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কাগজপত্র তলব করে বুঝে নিয়েছেন বিজয় কীভাবে রাজ্যসভার অবমাননা করেছেন।

তাই সাংসদ দম্পতির বিরুদ্ধে আনা তহবিল তছরুপসহ অন্যান্য অনৈতিক কর্মকাণ্ড আদালত ছাড়া সংসদের এথিকস কমিটি ছুঁয়েও দেখতে পারবে না, সেটা সংসদীয় সার্বভৌমত্ব বলে না। এ ধরনের যুক্তি বরং সংসদের বিশেষ অধিকারকে ক্ষুণ্ন করে।

আওয়ামী লীগ জঞ্জাল সাফ করার কথা বলে। আদালতের রায় ছাড়া সাংসদদের দুর্নীতি বিবেচনায় নেওয়া হবে না, এ অসংসদীয় সংস্কৃতির জন্য নিশ্চয়ই সামরিক শাসকদেরও দায়ী করা চলে। অবশ্যই বিএনপি-জামায়াতের শাসনকে দায়ী করা চলে। কিন্তু টানা প্রায় আড়াই মেয়াদ ক্ষমতাসীন থাকার পর সংসদের এথিকস বা প্রিভিলেজ কমিটি এত কাণ্ড ঘটে চলার পরও উঁহু শব্দটি পর্যন্ত করছে না, সেটা তো গ্রহণযোগ্য নয়। বরং এটা দুর্নীতির প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন। এখানে একটা গুরুতর অচলাবস্থা চলছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে শাসনের গুণমান উন্নয়নের জায়গা থেকে সাংসদ দম্পতিকে বহিষ্কার করা হোক।

সূত্র: প্রথম আলো, ৩০ নভেম্বর, ২০২০। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036299228668213