আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এমনিতেই বহুধা বিভক্ত। মাদরাসা শিক্ষায় আলিয়া, কওমি, নূরানী, হেফজ, হাফেজিয়া ইত্যাদি ধারায় কতসংখ্যক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক-শিক্ষার্থী আছে তার প্রকৃত তথ্য কারো কাছেই জানা নেই। এসব মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় সরকারের কোনো অনুমোদনও নেয়া হয় না। বই-পুস্তক, পাঠদান ইত্যাদি ক্ষেত্রে কেবলমাত্র আলিয়া মাদরাসাগুলো বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের নিয়ম অনুসরণ করে থাকে। কওমি মাদরাসা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের অধীন ছাড়াও আরো ৫টি বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে, নূরানী মাদরাসাগুলোর বোর্ডের নাম নুরানী তা’লীমুল কুরআন বোর্ড। এই মাদরাসা এবং শিক্ষা বোর্ডগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো আইন, বিধিবিধান অনুসরণ করে না। এতসব মাদরাসার পরও ক্যাডেট মাদরাসা, কেজিমাদরাসা ইত্যাদি নামেও গ্রাম ও শহরাঞ্চলে মাদরাসা শিক্ষা ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। কিন্তু কোনো ধরনের মাদরাসা বোর্ড বা মাদরাসা শিক্ষা কারিকুলাম, পাঠ্যবই কিংবা সহায়ক গ্রন্থের সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি এসব মাদরাসা অনুসরণ করে না। মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) ভোরের কাগজ পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানে কী পড়ানো হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা শিক্ষা শেষে কেমন জ্ঞানদক্ষতা অর্জন করছে, শিক্ষার্থীদের জীবনবোধ, কর্মক্ষেত্র দেশে আছে কি নেই সে সম্পর্কে শিক্ষক, অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের রয়েছে বলে মনে হয় না। আলিয়া মাদরাসা ছাড়া ধর্ম শিক্ষার বাইরে কোনো ধরনের মাদরাসায় অন্য কোনো শিক্ষা দেয়া হয় না। দেশে শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো কর্মক্ষেত্র গড়ে ওঠার মতো শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ এসব শিক্ষার্থীর থাকে না। এমনকি আরবি এবং ফারসি ভাষা জ্ঞানের দক্ষতাও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর অর্জনের সুযোগ সব ধরনের মাদরাসায় থাকে না। মূলত মাদরাসা, মসজিদ এবং ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল ইত্যাদিতেই শিক্ষার্থীদের কর্মক্ষেত্র খুঁজে নিতে হয়। সে কারণে অনেক শিক্ষার্থী নিজেরাই নতুন মাদরাসা কিংবা মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে থাকে। তবে সবার পক্ষে এ ধরনের কর্মক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব হয় না। ফলে পারিবারিক ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা অন্য কোনো কর্মসংস্থানের সুযোগ খুঁজে নেয়া ছাড়া বেশিরভাগ মাদরাসা শিক্ষার্থীর ভাগ্যে নির্ভরযোগ্য পেশা জোটে না।
অন্যদিকে আলিয়া মাদরাসা থেকে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কৃতী শিক্ষার্থী মূলধারার শিক্ষায় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষায় অবতীর্ণ হয়। সেখানে অনেকেই ভালো করে। তবে বড় সংখ্যক শিক্ষার্থীই আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার মধ্যে থেকে যেতে বাধ্য হয়। এরা নানা রকম সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে থাকে। কেউ কেউ সফলও হয়ে থাকে। গোটা মাদরাসা শিক্ষাই ধর্মীয় শিক্ষাভিত্তিক। তাতে জ্ঞানবিজ্ঞান শিক্ষা, নানা ধরনের পেশা ও কর্মদক্ষতা সৃষ্টির সুযোগ নেই বললেই চলে। সে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিও সেই শিক্ষার মধ্যে থাকে না। এতসব মাদরাসা ধারার শিক্ষা আমাদের সমাজের ওপর ক্রমাগত প্রভাব ও চাপ সৃষ্টি করছে। তা সার্বজনীন, বৈশ্বিক এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কাজে আসে না। অধিকন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রভাব ও প্রসার ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে চলছে। এটি আমরা দীর্ঘদিন উপেক্ষা করে এসেছি। কিন্তু এই সমাজেই তাদের অবস্থান বিস্তৃত হয়েছে। এরই মধ্যে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া লাখ লাখ শিক্ষার্থী সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজে খুব একটা যুক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের অর্জিত শিক্ষা রাষ্ট্র ও সমাজের উন্নয়নের কাজে ভূমিকা রাখার মতো নয়। ফলে বিশাল এই ধর্মীয় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের জন্য অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠছে। কিন্তু বৃহত্তর সমাজ, রাষ্ট্র এবং নীতি নির্ধারক মহল এ বিশাল সংখ্যক ধর্মশিক্ষায় শিক্ষিত তরুণদের সর্বজনীন শিক্ষার স্রোতে যুক্ত করতে পারছে না। এরাও শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে জ্ঞানবিজ্ঞান, তথ্যপ্রযুক্তি, মৌলিক বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হতে পারছে না। তাদের অর্জিত শিক্ষা জীবন ও জগতের এই অপরিহার্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের অনেকটাই দূরে সরিয়ে রেখেছে। বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা, একাত্মবোধ এবং দৃষ্টিভঙ্গিগত মিল খুব বেশি ঘটাতে পারছে না। পারার সম্ভাবনাও তাদের অর্জিত শিক্ষা থেকে আশা করা যায় না। রাষ্ট্র, সমাজ, প্রকৃতি এবং মানুষকে নিয়ে যে জীবনব্যবস্থা এগিয়ে নিতে হয় সেই শিক্ষার অভাব এদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আটকে ফেলে। সেখান থেকে মুক্ত হওয়া প্রায় অসম্ভব।
অন্যদিকে দেশে যে সাধারণ শিক্ষা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তার প্রসার ঘটলেও মানের সংকট মোটেও ঘুচানো যায়নি। সেখানেও রয়েছে নানা ধারা উপাধারার শিক্ষা। গ্রাম ও শহরের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতা। ফলে সাধারণ শিক্ষাও আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের বড় অংশকে মেধা, জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা, আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা ইত্যাদিতে বড় ধরনের কোনো শক্তি সঞ্চয় করাতে পারেনি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির চর্চার চাইতে প্রথাগত সামাজিক বিশ্বাস ও বোধের মধ্যে আমরা এখনো আটকে আছি। বিজ্ঞান শিক্ষা আমাদের মধ্যে এখনো ব্যাপক কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। মূলত ডাক্তার বা প্রকৌশলী হওয়ার চিন্তা থেকেই বিজ্ঞান শিক্ষায় পড়াশোনা করার মনোবৃত্তি শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মধ্যে কাজ করছে। বিজ্ঞান চিন্তা ধারণ করার বোধ তাতে খুব বেশি যুক্ত হয়নি। ফলে ডাক্তার কিংবা প্রকৌশলী হলেও বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ব্যক্তিজীবনে প্রভাব খুব কমই ফেলেছে। অন্যদিকে দার্শনিক রুশোর বিখ্যাত উক্তি বাংলাদেশের সমাজের ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। তিনি বলছিলেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করে স্বাধীনভাবে, কিন্তু সমাজ তাকে শৃঙ্খলিত করে। আমাদের সমাজেও দীর্ঘদিন থেকে কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা বিরাজ করে আসছিল। এগুলো রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দিন দিন প্রসারিত হয়েছে। শিক্ষার আলোয় সমাজের এসব পশ্চাৎপদতা দূরীভূত করার মতো ব্যাপকসংখ্যক মানুষ সৃষ্টি হয়নি। ফলে স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা যতটা আধুনিক শিক্ষা সংস্কৃতিতে বেড়ে ওঠার কথা ছিল ততটা হতে পারিনি। আমাদের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার কাছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমেই যেন নুয়ে পড়েছে। এগুলো আলো ছড়াতে পারেনি অন্ধকার সমাজের ওপর। মানুষের মধ্যে যুক্তি, জ্ঞানবিজ্ঞান, আধুনিক ধ্যান-ধারণা ইত্যাদির প্রসার না ঘটিয়ে তথাকথিত শিক্ষিতদের বড় অংশ আত্মসমর্পণ করেছে সমাজের প্রচলিত ভেদবুদ্ধি, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ইত্যাদি বিশ্বাসের ওপর। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে যতখানি মানসম্মত জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং আধুনিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মতো শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল, সেটি আমরা এখনো করতে পারিনি। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের পরিবর্তিত করতে পারছে না। এর প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের সাধারণ শিক্ষার মধ্যেও জ্ঞানবিজ্ঞান, সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তার বিষয়গুলো আধুনিক বিশ্বের শিক্ষার দর্শনে চর্চা করা হচ্ছে না। সে রকম শিক্ষাক্রম পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষক, পাঠদান, শিক্ষার্থীর মানস গঠন ইত্যাদি গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। আমরা বারবার আত্মসমর্পণ করছি সামাজিক অন্ধবিশ্বাসের কাছে। অথচ প্রয়োজন ছিল অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত করার জন্য আমাদের শিশু-কিশোর ও তরুণদের বুদ্ধিবৃত্তিক সৃজনশীল যুক্তি ও জ্ঞানচর্চায় যুক্ত করা। তাহলেই এরা প্রকৃত শিক্ষায় যেমন শিক্ষিত হতে পারত, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি সংস্কৃতি সর্বত্র এরা দক্ষ কারিগর হিসেবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারত। দুঃখজনক অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের সাধারণ শিক্ষাও যেমনিভাবে মানসম্মত হতে পারেনি একইভাবে সাম্প্রদায়িকতা, জাতিগত বিভেদ, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি এবং নানা ধরনের পশ্চাৎপদ চিন্তাধারায় আবদ্ধ থেকে গেছে। এর ফলে যে শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে সেই শিক্ষা আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেনি আলোও ছড়ায়নি। আমাদের শিশু-কিশোরদের আলোর পথও খুব বেশি দেখায়নি। সে কারণে আমরা শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে নাজেহাল করতে তারই শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান ক্লাসে অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধর্মীয় প্রশ্ন উত্থাপন করার ফন্দি-ফিকির করতে দেখি। একজন পুলিশ কনস্টেবল নারীর কপালে টিপ পরা দেখে কতটা অমানবিক অসৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারে তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। এছাড়া জনৈক স্কুলশিক্ষিকা ক্লাসে এক কোষ থেকে প্রাণের উৎপত্তির কথা আলোচনা করতেই শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ধর্মীয় শিক্ষার বিপরীতে এই শিক্ষা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলায় শিক্ষিকা শিক্ষকতা ছেড়ে দেন। স্কুলশিক্ষার্থীদের বয়সটি হচ্ছে শেখার, শেখানোর নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা এ কি দেখি! শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ শিক্ষকদের ফাঁদে ফেলতে মোটেও দ্বিধা করছে না, কারো অশুভ উদ্দেশ্য সাধনে তারা শিক্ষককেও অপদস্ত করতে বিবেকের চর্চা করছে না। এমন শিক্ষার্থীরা তো কখনো শিক্ষাকে ধারণ করতে পারবে না। সমাজে এখন যে অবক্ষয় চলছে, শিক্ষাব্যবস্থায় যে মানহীনতার সংকট চলছে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নতুন প্রজন্ম, আখেরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রও। যে রাষ্ট্রটির জন্য ১৯৭১-এ সাড়ে ৭ কোটি মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই এখন যে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীকে ভাবলেশহীনভাবে বেড়ে উঠতে দেখছি- সেটি খুবই আতঙ্কের বিষয়। এই আতঙ্ক দূর করতে গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতেই হবে। শিক্ষা মানুষ তৈরি করে, অমানুষ সৃষ্টি করে না। কিন্তু তার জন্য চাই বিজ্ঞানভিত্তিক কারিকুলাম, পাঠ্যবই, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার ব্যাপক আয়োজন। সেই কাজটিতেই হাত দিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে, জনমত সৃষ্টি করতে হবে শিক্ষার প্রকৃত দর্শনে ফিরে আনার। সাম্প্রদায়িকতামুক্ত শিক্ষাই পারে কেবল বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গঠন করতে।
লেখক : মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক।