কেউ কেউ বলে থাকেন বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্যের যুগে ওসব সাহিত্য-টাহিত্য দিয়ে কিছু হয়না, শিক্ষা বলতে ঐ বিজ্ঞান শিক্ষাটাই একমাত্র জরুরি। কথাটার সঙ্গে আমিও একমত পোষণ করতে পারি যদি বিনা বাক্যে মেনে নিই যে মানুষ কোনো সামাজিক জীব নয় বরং একটি প্রাণহীন রোবট বিশেষ। জ্ঞানী মাত্রেই বলবেন যে শিক্ষা মানে সামগ্রিক শিক্ষা বা holistic education. একজন বিজ্ঞানের ছাত্র যেমন পদার্থ, রসায়ন ও জীব/প্রাণিবিদ্যা সম্পর্কে জানবেন তেমনই তার সার্বিক মানসিক উৎকর্ষের জন্য সাহিত্য, সংগীতসহ সাংস্কৃতিক বিষয়েও জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
কিন্তু ক্লান্ত মস্তিষ্ক যদি সাহিত্যর হিমেল পরশ না পায় তবে একসময় সে মগজ ক্যাটালিস্টের অভাবে কর্মক্ষমতা হ্রাসের ঝুঁকিতে পড়ে। আর সম্ভবত সে কারণেই আমরা দেখতে পাই মেডিক্যাল সায়েন্স পড়েও সমারসেট মমের মতো একজন চিকিৎসক সাহিত্য সেবায় মেতে উঠছেন, আমাদের দেশের চিকিৎসক মোহিত কামাল, ডাক্তার শাহাদুজ্জামান, ডাক্তার মামুন হোসাইন ও তসলিমা নাসরীন প্রমুখদের এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক হুমায়ূন আহমেদ ও জাফর ইকবাল ভ্রাতৃদ্বয়ের সাহিত্য-জগতে দৃপ্ত পদক্ষেপ। শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য যেমন এক্সারসাইজের পাশাপাশি সুষম খাদ্য এবং গভীর ঘুমের প্রয়োজন তেমনই মেধা ও মননকে সুস্থ ধারায় প্রবাহিত করবার জন্য সাহিত্য-চর্চার বিকল্প নেই। ঘুমের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একজন জাপানি বিজ্ঞানী বলেন, Through deep sleep, we generate melatonin, a hormone that occurs naturally in our bodies. A powerful antioxidant, melatonin helps us live longer and it strengthens our immune system that protests cancer, promotes in production of insulin and prevents osteoporosis.
সাহিত্যের পরিসর অত্যন্ত বিস্তৃত। এখানে আছে গল্প, কাব্য, উপন্যাস, নাটক, আবার এখানেই নীরব উপস্থিতি জানিয়ে দিচ্ছে সংগীত, কলা, ধর্ম ও দর্শনের মত গুরুগম্ভীর বিষয়সমূহ। যে সাহিত্যকর্মের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল পেলেন, সেই গীতাঞ্জলিকে আমরা যদি কাব্য-সাহিত্য না বলে ধর্মকথা, প্রার্থনা-শ্লোক অথবা, ধর্মীয় দর্শন বলি তবে কি অতিরঞ্জন হবে? গীতাঞ্জলির শুরুটা যদি দেখি-
‘আমার মাথা নত করে দাও হে
তোমার চরণধুলার তলে।
সকল অহংকার হে আমার
ডুবাও চোখের জলে।’ অথবা,
‘বিপদে মোরে রক্ষা কর
এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যন করি ভয়।’
স্রষ্টার কাছে এর চেয়ে বড় আত্মসমর্পণ বা আত্মনিবেদনমূলক প্রার্থনা আর কী হতে পারে? এ লাইনগুলোতে কি কবিগুরুর ব্যক্তিগত দর্শন ও ধর্মানুভূতির প্রকাশ ঘটেনি? আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির বিরাট একটা জায়গা জুড়ে আছে লালনসংগীত বা লালনদর্শন। কাজেই সাহিত্যটা চর্চায় রাখলে ও বুঝলে আলাদা করে ধর্ম ও দর্শনকে বুঝতে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। আবার ঠিক উল্টো করে এভাবেও বলা যায় যে ধর্ম ও দর্শন বুঝলে সাহিত্যপাঠ আরো সহজ হয়ে যায়। ফারসি সাহিত্যের অনেক বড় একটা সম্পদ জালালুদ্দিন রুমীর ‘মসনবীয়ে রুমী’ যা সম্পূর্ণটাই আধ্যাত্মিক দর্শন। রুমীর সাহিত্যকর্ম বিশ্বনন্দিত। রুমীর প্রতিটি লাইনই ধর্মীয় বাণী যা সব ধর্মের জন্যই প্রযোজ্য। যেমন, তিনি লিখলেন-
‘চূঁ গরয আমদ হুনার পুশীদাহ শোদ
ছদ হেজাবায দিল বা সূয়ে দীদাহ শোদ’
অর্থ--স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার যখন উদ্দেশ্য হয়, তখন (কাজের) সৌন্দর্য বিলুপ্ত হয়। অন্তর হতে শত শত পর্দা চোখের সামনে এসে পড়ে। সাহিত্যের ধারায় পরিবর্তন আসে যুগের আবর্তনে, সংস্কৃতিতে আসে অন্তর্ভুক্তি বা অন্তর্নিবেশ। কেউ কেউ অন্তর্নিবেশকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলতে পছন্দ করেন। কোনো দেশের নিজস্ব সংস্কৃতিতে বিদেশীয় সংস্কৃতির স্বল্পমাত্রায় প্রবেশ যদি সামাজিক অবক্ষয় না আনে তবে তা গ্রহণযোগ্য। সাহিত্যেও সে কথা সমভাবে প্রযোজ্য। ইংরেজি সনেটের ধারা যখন মাইকেলের কাব্যে প্রবেশ করে নুতন ধারা সংযোজন করে তখন সেটি আমাদের সাহিত্যকে গাম্ভীর্য দান করে। রবীন্দ্র-কাব্য যখন মধ্যগগণে প্রখরতা ছড়াচ্ছে ঠিক তখনই কবিতার নুতন ধারা নিয়ে এলেন তরুণ কবি জীবনানন্দ দাশ যা বাংলা সাহিত্যে নুতন মাত্রা যোগ করলো এবং রবীন্দ্রধারাকে ম্লান না করে বরং বাংলা সাহিত্যের মর্যাদা বৃদ্ধি করলো, বাঙালি জাতি পেলো সাহিত্যের নুতন স্বাদ।
সাহিত্যের স্বাদ যেমনই হোক না কেনো, এটি মনের জন্য একটি সুষম খাদ্য। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা সাহিত্য করেন বা সাহিত্য পড়েন তারা বেশিরভাগই দুর্নীতিমুক্ত থাকেন। সাহিত্যিক বা সাহিত্যপ্রেমীদের মন ভারমুক্ত থাকে, বাহ্যিক স্ট্রেস বা চাপ তাদের খুব একটা কাবু করতে পারে না, তাদের মন থাকে আকাশের মতো উদার, সে কারণে তারা যেমন নিজের হৃদযন্ত্রকে সুস্থ রাখতে পারেন, একইভাবে তারা অন্যদের হৃদয়-ব্যথার কারণ হন না অবশ্য ব্যতিক্রমী দু-একজন ছাড়া। আমাদের সময় ষষ্ঠ হতে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত দ্রুতপঠন নামে একটি সাহিত্য-গ্রন্থ চালু ছিলো যা বর্তমানে নেই বলেই আমি জানি। ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম বিদ্রূপাত্মক রচনা জোনাথান সুইফট এর ‘গালিভার’স ট্র্যাভেলস’ আমরা দ্রুত পঠন হিসেবে পড়েছি যা পরবর্তীকালে উচ্চতর শ্রেণিতে সাহিত্য পড়তে এসে ভীষণভাবে কাজে এসেছে। বলা বাহুল্য, চাকরিজীবনে ব্যক্তিগতভাবে সৎ থাকার মন্ত্র সাহিত্যই দিয়েছে এবং Plain living and high thinking এর ধারণাটিও সাহিত্যের কাছেই পেয়েছি বলে সাহিত্যপাঠ কতটা জরুরি। এ বিষয়ে জোর প্রত্যয়ন করতে দু’বার ভাবতে হয় না।
লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়