মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে নতুন পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি, সিলেবাস ও নম্বর বন্টনের সিডি অবৈধ নোট-গাইড প্রকাশকদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিবেদনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা প্রশাসনসহ সারাদেশে। আজ রোববার শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ও ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ ‘নিষিদ্ধ নোট-গাইড কোম্পানি মালিকরা সিডি নিতে এনসিটিবিতে!’ শিরোনামে প্রতিবেদন দেখে নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। শিক্ষাখাত ধবংসের এমন অপকর্মে জড়িত পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও নোট-গাইড প্রকাশকদের খুঁজে বের করতে গোয়েন্দা সংস্থা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশের এসবি কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সংস্থাগুলোকে যতো দ্রুত সম্ভব অনুসন্ধানী প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। রোববার সকালে শিক্ষা উপদেষ্টা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে এমন নির্দেশনার কথা জানিয়েছেন।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ‘ আজ সকালেই দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকম-এর প্রতিবেদন দেখামাত্রই গোয়েন্দাদের নির্দেশ দিয়েছি দোষীদের খুঁজে বের করতে। কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।’
জানা যায়, গত প্রায় ২০ বছর ধরে পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সম্পাদনা শাখা থেকে পাঠ্যবইয়ের পাণ্ডুলিপি, নম্বর বন্টন ও সিলেবাসের আগাম তথ্য নোট-গাইড প্রকাশকদের কাছে মোটা অংকের বিনিময়ে হস্তান্তর করা হচ্ছে। যারা পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি পায় তাদের মধ্যে বড় ঠিকাদারদের নোট-গাইড কোম্পানি রয়েছে। আগাম তথ্য সংগ্রহ করে নোট-গাইড লিখে ও প্রকাশ করে বাজারজাত করে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করছে কয়েকটি কোম্পানি। তারা পাঠ্যবই ছাপা বন্ধ রেখে নোট-গাইড ছাপে। আর এসব অপকর্মে এনসিটিবির এক শ্রেণির কর্মকর্তা ও কর্মচারীর যোগ রয়েছে। পাঁচ আগস্টে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরও সম্পাদনা শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকম-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন দেখুন :
বরাবরের মতোই এবারো পাঠ্যবইয়ের পান্ডুলিপির সিডি (কমপ্যাক্ট ডিস্ক), সিলেবাস ও নম্বর বণ্টন নিতে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এনসিটিবিতে ঘুরঘুর করছেন নিষিদ্ধ নোট-গাইড কোম্পানির কতিপয় মালিক। যদিও গত ১৫ বছরে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে আইনে নিষিদ্ধ নোট-গাইডকে সহায়ক বই নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবে যাহা লাউ তাহাই কদু। আর পাঠ্যবই ছাপা স্থগিত রেখে নোট-গাইড বই ছাপছেন বই ছাপার ঠিকাদাররা। ফলে সময়মতো ৪১ কোটি পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণ নিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও দীপু মনির সিন্ডিকেট সদস্যদের অনেকেই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে বিদায় হলেও এবারও চড়া দামে পাণ্ডুলিপির সিডি কিনতে গাইড বইয়ের মালিকরা ঘুরঘুর করছে বোর্ডের সম্পাদনা শাখায়। কোনো কোনো গাইড মালিক সিডি কিনে গাইড ছাপা শুরু করেছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে নজরে এসেছে কর্তৃপক্ষের। এ নিয়ে অফিস আদেশও জারি করেছে এনসিটিবি। এতে বলা হয়েছে, “এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকসমূহের সিডি/পান্ডুলিপি/ড্যামি সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে যেনো কোনোক্রমেই গাইডবই প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করা না হয় সে বিষয়ে অধিকতর সতর্ক থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে বলা হলো।”
পৃথক আদেশে বলা হয়, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জন, পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন, সিলেবাস ও নম্বর বণ্টন, টেন্ডার ডকুমেন্ট তৈরি, পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের জন্য সিডি প্রদান ইত্যাদি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এসব কাজে সংশ্লিষ্ট সবাইকে গোপনীয়তা রক্ষা করতে বলা হলো।
অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ের চাইতে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সহায়ক বইয়ের নামে নিষিদ্ধ নোট-গাইড ছাপছে মর্মে অভিযোগ উঠেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তাদের মধ্যে অনুপম ও শতরুপা প্রকাশনী অন্যতম। এছাড়াও রাজধানীর মাতুয়াইলের বিভিন্ন ছাপাখানায় দেদার ছাপা হচ্ছে নোট-গাইড বই।
ছাপাখানা মালিক ও এনসিটিবি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত কয়েকবছর ধরে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে সহায়ক বইয়ের নামে বিক্রি হওয়া ‘নিষিদ্ধ নোট-গাইড’ বইয়ের মুদ্রণ ও বাজারজাতকরণ বন্ধ রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির কাছে অনুরোধ করা হয়েছিল। একই সঙ্গে খোলাবাজারে এই ধরনের নিষিদ্ধ বইয়ের বিক্রি ঠেকাতে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারদের চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেসবই ছিলো লোক দেখানো। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার কোনো নজির নেই।
বছরের এই সময়টায় পাঠ্যবই ছাপা হয়। এই সময়ে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ‘নোট-গাইড’ বা ‘সহায়ক’ বই ছাপা হলে, বাজারজাতকরণ হলে পাঠ্যপুস্তক ছাপার কাজ ব্যাহত হয়। তাছাড়া এবার দেশের কাগজের ‘তীব্র’ সংকট রয়েছে।